আজও বেদখল শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জিসি দেবের বাড়ি

রাজীব রাসেল, সিলেট প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২২, ০১:৩০ পিএম

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও দখলমুক্ত হয়নি বিশ্ববরেণ্য মানবতাবাদী দার্শনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জিসি দেবের পৈতৃক বাড়ি। ২০০৮ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) পদকে ভূষিত করে জাতি আংশিক দায়মুক্ত হলেও, তাঁর পৈতৃক বাড়িটি দখলমুক্ত করা হয়নি আজও।

ড. জিসি দেবের পদকপ্রাপ্তি সিলেটের বিয়ানীবাজারবাসীকে যতটা গর্বিত করেছে, ততটা হতাশ করেছে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়ায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় দখলদাররা স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য নির্মাণ করেছেন পাকা ঘর।

এ অবস্থায় স্থানীয় সুশীল সমাজের মত, অনতিবিলম্বে বাড়িটি দখলমুক্ত করে ড. জিসি দেব জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক। কিংবা তার স্মৃতি রক্ষার্থে এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হোক যেটা নতুন প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস এলে নানা আলোচনায় বাড়িটি উদ্ধারের কথা উঠলেও পরবর্তী কালে ঝিমিয়ে পড়ে সকল কার্যক্রম। ইতোমধ্যে ড. জিসি দেবের স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনের নাম করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নাম সর্বস্ব বিভিন্ন সংগঠনের। কাগজে-কলমে এসব সংগঠনের নাম থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কিছুই দেখা যায় না।

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ১১ নম্বর লাউতা ইউনিয়নের নন্দিরফল গ্রামে ড. জিসি দেবের পৈতৃক বাড়ির পুরো জায়গাটাই রয়েছে দখলদারদের কবলে। দখলদাররা সেখানে বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে।

জানা গেছে, ড. জিসি দেবের পৈতৃক বাড়িতে মোট ভূমির পরিমাণ ২.৪৭ শতক। ১৩৬ নম্বর জে এল নন্দিরফল মৌজায় ৯০, ৯১ ও ৮৮ নম্বর দাগে বসতবাড়িতে ড. জিসি দেবের নামে ৩৫ শতক এবং একই দাগে তাঁর ভাই পুলিন বিহারী দেব, বিনোদ বিহারী দেব, বীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, ফতেন্দ্র চন্দ্র দেব ও হরিপ্রসাদ দেবের নামে অবশিষ্ট জায়গা রয়েছে।

এছাড়া নন্দিরফল মৌজার ৮৯ দাগে ১৩ শতক জায়গার ওপরে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরে ১৩ শতক জায়গার মধ্যে ড. জিসি দেবের নামে ৭ শতক জায়গা রয়েছে এবং অবশিষ্ট জায়গা তার অন্যান্য ভাইদের নামে রয়েছে। কিন্তু ড. জিসি দেব এবং তার ভাইদের কোনো উত্তরাধিকার না থাকায় ভিপি ‘ক’ তপশীল এবং প্রত্যর্পণ তালিকায় বর্ণিত দাগসমূহের ভূমি বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ৭/৭১-৭২, ৪৫/৭৪-৭৫ এর অনুকূলে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়। বিএস রেকর্ডে বর্ণিত দাগসমূহে মোট ১ একর জায়গা বাংলাদেশ সরকারের নামে ১/১ নম্বর খতিয়ান রেকর্ড হয় এবং ৫৩ নম্বর খতিয়ানে মোট ১.৪৭ একর জায়গা স্থানীয় জিসি দেব স্মৃতি সংসদের নামে চলমান জরিপে রেকর্ড করা হয়েছে।

এদিকে অভিভাবকহীন হিসেবে পড়ে থাকার কারণে একাধিক ব্যক্তি এসব জায়গা কাগজে-কলমে লিজ দেখিয়ে পাকা ঘর নির্মাণ করে স্থায়ী দখলের পাঁয়তারা করে চলেছেন।

প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান রেকর্ড অনুযায়ী এসএ ৯০ দাগে মুকুল লাল দেব ০.০৬৭৫ জায়গা লিজ নিয়েছেন। একই দাগে আপন চন্দ্র মালাকার গংয়ের নামে ৩৮ শতক জায়গা লিজ নেওয়া হয়েছে। পরেশ চন্দ্র মালাকার ০.৩৯২৫ জায়গা লিজ নিয়েছেন। ছমিক উদ্দিন ৩৫ শতক জায়গা লিজ নিয়েছেন। এছাড়া রেকর্ড অনুযায়ী ৯১ দাগে সুধাংশু চন্দ্র কালার নামে ৪৪ শতক জায়গা লিজ নেওয়া হয়েছে। একই দাগে আতাই মিয়া নামে ৩০ শতক জায়গা লিজ নেওয়া হয়েছে। এসএ রেকর্ডে ৮৮ ও ৮৯ দাগে ছমিক উদ্দিনের নামে ৪৬ শতক জায়গা লিজ নেওয়া হয়েছে।

বাড়িটির অধিকাংশ জায়গার বর্তমান দখলদার ছমিক উদ্দিন বলেন, “আমরা ড. জিসি দেবকে সম্মান করি। আমিও চাই তার নামে যে জায়গা রয়েছে সেই জায়গা যদি আমার নামেও লিজ থাকে, তাহলে সরকার যদি চায় আমি সেই জায়গাটি ছেড়ে দেবো। কিন্তু বাড়িটির পুরো জায়গা তো আর আমার নামে লিজ নয়। তাই যারা লিজ নিয়েছেন তাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই গুণী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে জিসি দেবের নামে কোনো স্মৃতিচিহ্ন বা কোনো স্থাপনা নির্মাণে সহযোগিতা করা। কিন্তু প্রথমে সরকারকে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমি নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম বাড়িতে ড. জিসি দেবের নামে যে অংশ রয়েছে সেই অংশটি যেন সবাই মুক্ত করে দিয়ে সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, যাতে জিসি দেব সম্পর্কে সবাই জানতে পারে।”

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন যিনি, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও সেই ড. জিসি দেবের সম্পত্তি দখলমুক্ত না হওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। বাড়িটি উদ্ধার করতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন চলে এলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন।

কেবল তা-ই নয়, ৭ কাঠা জমির ওপর ঢাকায় ড. জিসি দেবের আরেকটি বাড়ি রয়েছে, যা বর্তমানে সম্পূর্ণ বেদখলে। ড. জিসি দেব বাড়িটি হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে লোন নিয়ে কিনেছিলেন। বাড়ির অর্ধেক অংশ পালিত পুত্র ও পালিত কন্যার নামে এবং অর্ধেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উইল করে যান ড. জিসি দেব।

স্বাধীনতা পদকে ভূষিত ড. জিসি দেবের সম্পত্তি দখল প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার সভাপতি আমান উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও জিসি দেবের বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়া সমগ্র দেশ এবং জাতির ব্যর্থতা।

ড. জিসি দেবকে স্বাধীনতা পদক সম্মাননা আরও অনেক আগে দেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করে সুজন সভাপতি আরও বলেন, স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায়। অতএব এখনই দলখলমুক্ত করার উপযুক্ত সময়। কেবল পদক দেওয়ার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র দায়মুক্ত হলে চলবে না। তাঁর সম্পূর্ণ সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে হবে।

বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব বলেন, “দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার ড. দেবকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদক প্রদানের মধ্য দিয়ে যেভাবে প্রমাণ করেছে বাঙালি গুণীজনের সমাদর জানে, ঠিক একইভাবে তাঁর সকল সম্পত্তি দখলমুক্ত করে দেওয়া এই সরকারের উচিত।”

এ বিষয়ে লাউতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোওয়ার হোসেন বলেন, “আমি জিসি দেবের বাড়ির জায়গা উদ্ধারে সবসময় চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো অজানা কারণে আজ পর্যন্ত বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পারিনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যদি এই গুণী লোকের বাড়ি দখলমুক্ত না হয়, তাহলে আর কখনই এই বাড়ি দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে না।”

বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল বলেন, “ড. জিসি দেবের পৈতৃক বাড়ির সমস্ত জায়গা দখলমুক্ত করতে আমরা সবসময় আন্দোলন করছি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখন পর্যন্ত বাড়ির জায়গাটি দখলমুক্ত করা হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব বাড়িটি দখলমুক্ত করে এখানে কোনো মিউজিয়াম কিংবা ড. জিসি দেবের স্মৃতি রক্ষার্থে এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হোক যাতে নতুন প্রজন্ম এই গুণী মানুষটি সম্পর্কে জানতে পারে।”

এ বিষয়ে বিয়ানীবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিম, বলেন, “ড. জিসি দেবের পৈতৃক বাড়িটি দখলমুক্ত করতে আমি এসি ল্যান্ডকে নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে বাড়িটি উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট জমা দিয়েছি ডিসি মহোদয়ের কাছে। ডিসি মহোদয়ের অনুমতি পাওয়া মাত্র আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে বাড়ি দখলমুক্ত করে ড. জিসি দেবের নামে মিউজিয়াম করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবো।”  

পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজারের কৃতী সন্তান আধুনিক মানবতাবাদী দর্শনের পথিকৃৎ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (ড. জিসি দেব) ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বালক বিদ্যালয় দিয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এরপর মাধ্যমিক স্কুল, যা পরবর্তী সময়ে লাউতা উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপ নেয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চবিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ও অংকে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম স্থান অর্জন করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে (বর্তমানে স্যার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। এছাড়া তিনি দেশ-বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন।

ড. দেবের মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘দি গোবিন্দ সেবা ফাউন্ডেশন ওয়ার্ল্ড ফর ব্রাদারহুড’ এবং ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ‘দেব সেন্টার ফর ফিলসফিক্যাল স্টাডিজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে জাতিকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে এই জ্ঞান প্রদীপকে হত্যা করে।