বিরল উদ্ভিদের দেখা মিলবে যে উদ্যানে

মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, কুমিল্লা প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২২, ০৮:১৯ এএম

উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় ইট বিছানো পথ। পথের দুই পাশে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহার। ইটের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই একটু পরপরই দেখা মেলে উদ্ভিদের পরিচিতি বোর্ডের। সেখানে রয়েছে উদ্ভিদের বিস্তারিত বর্ণনা। এখানে আছে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশঝাড়ও। কুমিল্লার পর্যটন নগরীখ্যাত কোটবাড়ি এলাকার লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানে গেলে এমন নান্দনিক দৃশ্যই এখন চোখে পড়ে ।

এই উদ্ভিদ উদ্যানের ইটের রাস্তায় সবুজের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে শরীরের সব ক্লান্তি যেন নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ তো রয়েছেই। সবুজ প্রকৃতি আর পাখির শব্দ শুনে বাড়ি ফিরতে মন চায় না ভ্রমণপিপাসুর।

কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগ সূত্র জানায়, কুমিল্লা নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোটবাড়ি ময়নামতি জাদুঘরের কাছে সালমানপুর নামক স্থানে প্রায় ১৭ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে উদ্যানটি। এখানে রয়েছে কয়েক শ প্রজাতির উদ্ভিদ। যার অন্তত ৯০ শতাংশ বিপন্ন ও দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির। ভবিষ্যতে এ উদ্যানটির বিস্তৃতি আরও বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। বর্তমান উদ্যানের নিকটবর্তী বন বিভাগের ৩০ একরের মতো প্রাকৃতিক শালবাগান রয়েছে। মাঝে আরও প্রায় ৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হলে লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি অনেক সমৃদ্ধ হবে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে এমন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সামাজিক বন বিভাগ। ঢাকার মিরপুর ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের পর লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি দেশের তৃতীয় বিরল উদ্ভিদ উদ্যান। ২০১৫ সালে এটির কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের শুরুতে শেষ হয়। এ উদ্যানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণ, বন্য প্রাণীর নির্ভয় আবাসস্থল তৈরি, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়া বিনোদনের ব্যবস্থা ও স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

বর্তমানে উদ্যানটিতে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ রাধাচূড়া, নাগেশ্বর, আগার, নাগলিঙ্গম, কাঞ্চন, অশ্বত্থ, চন্দন, রক্তচন্দন, চালমুগরা, লোহাকাঠ, চাপালিশ, ধূপ, বাবলা, হরীতকী, বহেরা, হিজল, কনক, তমাল, অশোক, সিভিট, উড়ি আম, বন পেয়ারা, অর্জুন, মহুয়া, তেলশুর, পুঁটিজাম, বাঁশপাতা, কুম্ভি, পিতরাজ, পারুল, জারুল, চম্পা, টগর, বেলি, চিকরাশি, হরিয়ান, লটকন, ফেন্স, বোটলব্রাশ, বাসক, রঙ্গন, করমচা, সোনালু, বট ও কৃষ্ণচূড়ার সমাহার রয়েছে। এ উদ্ভিদ উদ্যানে আরও রয়েছে ক্যাকটাস হাউস, অর্কিড হাউস, বিভিন্ন ফুলের বাগান, বিরল উদ্ভিদ বাগান, বন্য প্রাণীর জন্য জলাশয়, বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস। এখানে দর্শনার্থীদের বসার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কিছু আরসিসি বেঞ্চ, ব্যাঙের ছাতা সাদৃশ্য বিশ্রামাগার। নির্মাণ করা হয়েছে পৃথক শৌচাগার।

গত ২০২০ সালের ৭ নভেম্বর দর্শনার্থীদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বিরল উদ্ভিদের এই উদ্যানটি। উদ্যানটির উদ্বোধন করেন বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসেন চৌধুরী।

উদ্যানে প্রবেশ করতে দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের হার নির্ধারণ করা আছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও শিক্ষার্থীদের জন্য টিকিট ৫ টাকা, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা এবং বিদেশিদের জন্য ৪০০ টাকা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ উদ্যান।

তবে লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানে গিয়ে দেখা গেছে অযত্নের ছাপও। প্রবেশপথেই যে গোলাপ বাগান সেখানে শতাধিক রকমের গোলাপ গাছ থাকলেও, দেখে মনে হয়েছে এই প্লটটি থাকে অযত্নে। এছাড়া ক্যাকটাস ও অর্কিডের গ্রিন হাউজে গিয়ে দেখা গেছে, রোদ বৃষ্টিতে জীর্ণ দশা। ঝরে পড়ছে ছাউনি। অপর দিকে ছোট্ট পুকুর পাড়ে যাওয়ার যে সিঁড়ি পাহাড় বেয়ে নেমে গেছে, তা শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। যা দর্শনার্থীদের খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

জেলার নাঙ্গলকোট থেকে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী বশির আহম্মেদ বলেন, “আমরা বৌদ্ধ বিহারে ঘুরতে এসেছিলাম। পরে এই উদ্যানের কথা জেনে এখানে এলাম। এখানে অনেক গাছ আছে, যেগুলো আমি জীবনেও দেখিনি। অবাক হয়েছি আগর ও ধূপের সুগন্ধওয়ালা গাছ দেখে।”

দেবিদ্বার থেকে ঘুরতে আসা মামুন মিয়া বলেন, “বাগানের পরিবেশ অনেক সুন্দর। কিন্তু বেশ ঝোপঝাড় হয়ে আছে, সিঁড়ি ও পুকুর পাড়টা পরিচ্ছন্ন রাখলে আরও সুন্দর দেখাবে।”

কুমিল্লার হাউজিং এলাকার এনজিও কর্মী অজিত কুমার মণ্ডল বলেন, “পূজার ছুটিতে ঘুরতে এলাম। এখানে অনেক ধরনের গাছ আছে। শেখার মত, জানার মত অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আরও বেশি গোছানো হলে সবগুলো গাছ খুঁজে পেতে মানুষের সহজ হতো।”

কুমিল্লা বন বিভাগের প্রধান বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, “এখানে যেসব গাছ আছে, তা এখন খুব একটা দেখা যায় না। গাছগুলো আসলেই বিরল। এই উদ্যানটি বর্তমান প্রজন্মকে ভুলতে বসা অনেক প্রজাতির গাছকে পরিচিত করে তুলবে। পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়েছে লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানটি। এখানে রয়েছে বসে অবসর কাটানোর সুযোগ। আর এ উদ্যান নতুন প্রজন্মকে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সম্পর্কে ধারণা দেবে। স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এটির আয়তন আরও বাড়ানোর জন্য আমরা অধিদপ্তরে আবেদন করেছি। ময়নামতি জাদুঘরের মতো এখানে ফরেস্ট মিউজিয়াম করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আবেদনে।”