ভালো নেই সাতক্ষীরার সুন্দরবনের কোলঘেঁষা উপকূলের মানুষ। জীবন বাঁচাতে, জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে যান তারা। কেউ যান মাছ ধরতে, কেউ যান কাঠ কাটতে, কেউ বা মধু সংগ্রহ করতে। আর এরই মাঝে কখনো কখনো এসব জেলে, বাওয়াল ও মৌয়ালদের ওপর হামলে পড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। খুব কম লোকই বাঘের কবল থেকে জীবিত ফিরে আসেন। আর যেসব বনজীবী মারা যান তাদের স্ত্রীদেরই সমাজ নাম দিয়েছে ‘বাঘ বিধবা ‘।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ বাজারের জেলে পাড়ায় থাকেন প্রায় ৩০ জন বাঘ বিধবা। বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। সমাজ তাদের একরকম প্রত্যাখ্যান করেছে। খেয়ে না খেয়ে বঞ্চনা নিয়ে কাটছে তাদের এক একটি দিন।
জেলে পাড়ার বাঘ বিধবা সোনামণি সর্দার জানালেন, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি বঞ্চনার শিকার। তার দুই স্বামীকে বাঘে খেয়েছে। সমাজের লোকেরা তাকে অপয়া- অলক্ষ্মী হিসেবেই দেখে। যেতে পারেন না কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে। বাজারের দোকান ঝাড়ু দিয়ে, হোটেলের থালাবাসন মেজে, সুন্দরবনের নদীতে পোনা মাছ শিকার করে চলছে তার জীবন। দুই স্বামীকে বাঘে খেলেও আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় তিনি ভয় নিয়ে মাঝে মাঝে বনে যেতে বাধ্য হন। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ওঠে, যখন সুন্দরবনের নদীতে বছরে ৬ মাস মৎস্য শিকার সরকারিভাবে নিষিদ্ধ থাকে।
এদিকে বাঘ বিধবা আর একজন আন্দারি বালা। তিনি জানান, তার স্বামীকে বাঘে খেয়েছিলো তার বিয়ের কয়েক বছর পরেই। তারপর থেকে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি। সমাজ তাকেও অলক্ষ্মী বলে আখ্যা দিয়েছে। কোনো সহায়তা পান না তিনি স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধি থেকে। কোনো প্রকার ভাতার কার্ড তিনি পান না। কারণ কুসংস্কার প্রচলিত আছে স্বামীকে বাঘে খেয়েছে তার জন্যই।
অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো বুলি দাসীর। তার স্বামী আর ভাই সুন্দরবনে গিয়েছিলেন জীবিকার তাগিদে। কিন্তু ২০০২ সালে মাছ ধরার সময় বাঘে আক্রমণ করে মুখে করে নিয়ে যায় বনের ভেতর। সেখান থেকে এক দফা বাঘের সঙ্গে লড়াই করে তার শ্যালক ছাড়িয়ে আনলেও কিছুক্ষণের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আক্রমণে পরাস্ত হন তিনি। এ সময় তার পায়ের একটি অংশ ছিঁড়ে নিয়ে যায় বাঘ।—এক বুক কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলেন বুলি দাসী। সমাজে তাকেও অলক্ষ্মী হিসেবে গণ্য করা হয়। কোনো শুভ অনুষ্ঠান তথা বিয়ে, পূজায় তাকে ধরতে দেওয়া হয় না বরণডালা। সমাজ থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সামাজিক বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করেন এই জেলে পাড়ার আরেক বিধবা দীপালী মণ্ডল। তারও ছোট থাকতে বিয়ে হয়েছিলো। স্বামীকে বাঘে খাওয়ার পর তার কপালেও জোটেনি কোনো প্রকার ভাতা। ছেলে-মেয়কে দুবেলা খাওয়াতে ও সংসার চালাতে তাকেও এখন ডাকাত, বাঘ ও কুমিরের ভয় নিয়ে বাধ্য হয়ে যেতে হয় জঙ্গলে।
কুসংস্কার সুন্দরবন উপকূলীয় এসব অসহায় মানুষগুলোকে আরও অসহায় করে তুলেছে। নিরপরাধ এসব নারীদের অপয়া আখ্যা দেওয়া হয়।
কীভাবে বাঘ আক্রমণ করে তার বর্ণনা দিয়েছেন জেলে সুভাষ মণ্ডল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন বাঘের মুখ থেকে। কিন্তু তার শরীরে রয়েছে গভীর সব ক্ষত। হয়তো তিনি না ফিরলে তার স্ত্রীকেও একই বঞ্চনার শিকার হতে হতো।
বাঘ বিধবাদের অধিকাংশই অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছেন। বাচ্চাদের নিয়ে অসহায় জীবন থেকে যেমন তারা মুক্তি চান, তেমনি কুসংস্কারের জাল ছিঁড়ে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা চান প্রশাসনের কাছে।
বাঘ বিধবাদের বঞ্চনা নিয়ে কথা বলতে গেলে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন, তাদের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতার তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তারা সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়া আরও যাচাই বাছাই করা হচ্ছে, তাদের অধিকতর কোনো সহযোগিতা করা যায় কিনা।