পঞ্চমী শেষ। শনিবার (১ অক্টোবর) থেকে শুরু হয়েছে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব, শারদীয় দুর্গোৎসব। মহাষষ্ঠীতে সায়ংকালে বোধন হয়েছে মণ্ডপগুলোতে চিন্ময়ী আনন্দরূপিণীর। এ বছর দূর কৈলাস ছেড়ে দেবী পিতৃগৃহে এসেছেন ঘোটক অর্থাৎ ঘোড়ায়। ‘সুদর্শন’ পঞ্জিকামতে, ঘোড়ায় আগমন বা গমনের ফল—ছত্রভংস্তুরঙ্গমে অর্থাৎ ছত্রভঙ্গ, ধ্বংস বা ছন্নছাড়া বা ধ্বংসাত্মক লীলার আশঙ্কা।
দুর্গোৎসবের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এ ছাড়া মণ্ডপকে আরও আকর্ষণীয় করার কাজ নিয়েও ব্যস্ত আয়োজকরা। প্রতিবছরই ভিন্নধর্মী থিম নিয়ে মণ্ডপ সাজিয়ে থাকেন রাজশাহীর আয়োজকেরা। প্রতিবার আলোচনার কেন্দ্রে থাকে ‘টাইগার সংঘ’। এবার আসন্ন কাতার বিশ্বকাপের ট্রফির আদলে মণ্ডপ সাজিয়ে তাক লাগাতে যাচ্ছে সংগঠনটি।
রাজশাহী নগরের রাণীবাজার মোড়ে টাইগার সংঘের পূজার মণ্ডপটিতে এবার থাকছে ২৬ ফুটের একটি বিশ্বকাপ ট্রফির আদল। সঙ্গে থাকবে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ৩২টি দেশের পতাকা। ঠিক মাঝখানে থাকবে বাংলাদেশের পতাকা। পাশেই থাকবে একতাবদ্ধের প্রতীক।
আয়োজকেরা জানান, এবার টাইগার সংঘের ৪০তম পূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর করোনার সচেতনতায় করোনা ও মাস্ক দিয়ে থিম করা হয়েছিল। এর আগে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুকে স্মরণ করে রুপালি গিটারে সেজেছিল মণ্ডপ। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বাহুবলী, ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখের অবয়ব দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করে প্রশংসা কুড়ায় টাইগার সংঘ। এবার টাইগার সংঘের পূজামণ্ডপটি সাজানো হয়েছে দুইভাবে। প্রতিমা ও মঞ্চ উভয়ই পৃথক অর্থ বোঝাবে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পার্থ পাল চৌধুরী বলেন, “বরাবরই শারদীয় দুর্গোৎসবে নতুন আর ব্যতিক্রমী সাজে মণ্ডপ সাজায় টাইগার সংঘ। এবার আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনার কথা মাথায় রেখে ২৬ ফুটের একটি ট্রফি ও বিভিন্ন দেশের পতাকা এবং বিশ্বকাপ লোগো দিয়েই থিম করা হচ্ছে। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের ইভেন্ট পয়েন্টগুলো দিয়ে মণ্ডপ সাজানোর চেষ্টা করা হবে। প্যান্ডেলের রংও হবে ফিফার অফিশিয়াল চারটি রঙে।”
তিনি আরও বলেন, “থিমের সাইজ হবে ৪২ ফুট ও ৩০ ফুট। মূল ট্রফিটি হবে ২৬ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া। এটি ৪০ ফিট করার কথা ছিল। কিন্তু সেই প্রযুক্তি না থাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে। এ ছাড়া ৩২টি দেশের পতাকাও থাকবে। আমাদের প্রতিমাও এবার রাজশাহীর মধ্যে সবচেয়ে বড় হবে। এটি লম্বায় হবে ১২ ফুট। প্রতিমা বসানোর স্থানটিও বিশ্বকাপ ট্রফির নিচের আদলে বানানো হয়েছে।”
পিছিয়ে নেই অন্য আয়োজক কমিটিগুলোও। কারণ প্রতিবছরই রাজশাহীর পূজা মণ্ডপগুলোতে সাজসজ্জায় একধরনের প্রতিযোগিতা চলে। তাদের মধ্যে অন্যতম নগরীর সাগরপাড়া এলাকার শিবালয় মন্দির। তারা রাজশাহীতে সিনেমা হলের অভাব বোঝাতে এবং সেই পুরোনো স্মৃতি নিয়ে গত বছর মণ্ডপ সাজিয়ে প্রশংসিত হয়। এবার তারা ভাবছে ভিন্নধারায়। পুরো বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়েই এবার হবে তাদের থিম। তাদের মূল বার্তা হবে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’।
শিবালয় মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দেবাশিষ প্রামাণিক দেবু বলেন, “এবার আমরা চেষ্টা করছি যুদ্ধ নয় শান্তি চাই থিম নিয়ে একটি মণ্ডপ সাজাতে। সারা বিশ্বের যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তা তুলে ধরতে চাই। এ মুহূর্তে বিশ্বের ১০টি দেশে সম্মুখযুদ্ধ হচ্ছে। আর ২৭টি দেশে গৃহযুদ্ধ হচ্ছে। মূলত এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং তাদের যুদ্ধের কিছু খণ্ডচিত্র দিয়েই এবার মণ্ডপ সাজানো হবে।”
রাজশাহীতে এবার ৪৫২টি মণ্ডপে দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে রাজশাহী নগরীতে ৭৫টি ও জেলার ৯টি উপজেলায় ৩৭৭টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হবে। এসব উপজেলার মধ্যে গোদাগাড়ীতে ৩৯টি, তানোরে ৬০টি, পবায় ১৮টি, মোহনপুরে ২২টি, পুঠিয়ায় ৫১টি, দুর্গাপুরে ১৭টি, চারঘাটে ৪১টি, বাঘায় ৪৬টি, বাগমারায় ৮৩টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার বলেন, “গত দুই বছর করোনার প্রকোপের কারণে কিছুটা সীমিত আকারে পূজা উদযাপন করতে হয়েছে। এবার পরিবেশ ভালো হওয়ায় অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশেই পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদযাপন হবে।”
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রফিকুল আলম বলেন, “আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে এরই মধ্যে নগরীতে আমেজ লক্ষ করা গেছে। নগরীর সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেক ভালো রয়েছে। এরই মধ্যে পূজামণ্ডপে সিসিটিভি স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পূজাকে ঘিরে নিয়মিত পুলিশ টহলের বাইরেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। নগরীতে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ও সাদা পোশাকে পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। পূজাকে ঘিরে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই।”