কতটা পর্যটনবান্ধব হতে পেরেছে রাঙামাটি

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০৮:৩৫ এএম

রাঙামাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন জেলা। বিশাল কাপ্তাই লেক, সেই লেকের মধ্যে ডুবে থাকা পাহাড়, পাহাড়ি নদী আর ঝরনার জীবন্ত এক ক্যানভাস। আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাহাড় ও লেকের  সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাঙামাটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। সব ঋতুতে পর্যটকদের মুখরিত হয়ে থাকে। চারদিকে লেক, বন-বনানী, আঁকাবাঁকা পথ ও কাপ্তাই হ্রদের অকৃত্রিম বিশালতার সমন্বয়ে গঠিত এই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি।

প্রতিবছর ভ্রমণপিপাসু মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের আশায় ছুটে আসের এই জেলায়। বিশেষ করে শীতের মৌসুমে পর্যটকদের আসা-যাওয়া চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের বৃহৎ জেলা হিসেবে পরিচিত এই রাঙামাটিতে রয়েছে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা।

১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাঙামাটি জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা মত। কেউ মনে করেন হ্রদের পানিপ্রবাহের সময় লাল রং দেখায় বলে এই জেলার নাম রাঙামাটি। আবার কেউ কেউ মনে করেন মাটির রং লাল বলে এই জেলার নামকরণ হয়েছে রাঙামাটি।

পার্বত্য রাঙামাটি এই  জেলায় পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে সিম্বল অব রাঙামাটি খ্যাত ঝুলন্ত সেতু, দেশের প্রথম পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র (কাপ্তাই-রাঙামাটির হ্রদ), সুবলং ঝরনা, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্থল,
রাজবনবিহার (বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান), কাপ্তাই রাঙামাটির সংযোগ সড়ক, আরণ্যক রিসোর্ট, পলওয়েল পার্ক, আসাম বস্তি।

ঝুলন্ত সেতু

রাঙামাটি শহরের শেষ প্রান্তে কর্ণফুলী হ্রদের ওপরে রয়েছে ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু। হ্রদের দুই পাশের দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করে ঝুলন্ত সেতু দাঁড়িয়ে আছে। এটি সিম্বল অব রাঙামাটি হিসেবেও পরিচিত পেয়েছে।

সুবলং ঝরনা

সুবলং ঝরনা রাঙামাটি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বরকল উপজেলায় অবস্থিত। দেশের সবচেয়ে উঁচু ঝরনা হিসেবে পরিচিত এটি। বর্ষায় তার প্রাণ ফিরে পায়। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নেমে আসা পানির পর্যটকদের ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। নৌপথে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুল রউফের সমাধি

মূল শহর থেকে নৌপথে ১৫ কিলোমিটার দূরে স্বচ্ছ জলরাশি দ্বারা বেষ্টিত ছোট দ্বীপ বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি। এর চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদের বিমোহিত করে।

কাপ্তাই হ্রদ

কাপ্তাই হ্রদ বা লেক বাংলাদেশের এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎতম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদু পানির হ্রদ। এটি প্রধানত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৃষ্টি হলেও এই জলাধারে প্রচুর পরিমাণে মিঠা পানির মাছ চাষ হয়। চাষকৃত মাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়।

আরণ্যক রিসোর্ট

সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত হলেও এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। লেক আর পাহাড়ের অপরূপ সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই রিসোর্ট পর্যটকদের ভিন্ন বিনোদন মাধ্যম।

পলওয়েল পার্ক

রাঙামাটি জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে নির্মিত পলওয়েল পার্ক ইদানীং ব্যাপক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।

রাঙামাটি জেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। এ নদী ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে রাঙামাটির উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ঠেগা নদীর মোহনা হয়ে এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। কর্ণফুলী নদীর উপনদীগুলো হল কাচালং, মাইনী, চেঙ্গি, ঠেগা, সলক, রাইংখ্যং।

এই জেলায় জুম পদ্ধতিতে পাহাড়ে চাষাবাদ হয়ে থাকে। উৎপাদিত প্রধান শস্যগুলো হল ধান, পাট, আলু, তুলা, ভুট্টা, সরিষা। এছাড়া এ জেলায় প্রচুর পরিমাণে ফলদ ও বনজ গাছের বাগান রয়েছে, যা বাইরে রপ্তানি করে এ জেলার লোকেরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রধান রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে কাঁঠাল, আনারস, বনজ পণ্য, কাঠ ইত্যাদি। এ ছাড়া এ জেলায় আম, কলা, লিচু, জাম ইত্যাদি ফলের প্রচুর ফলন হয়। কাজুবাদাম বর্তমানে রাঙামাটির অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে।

জেলায় রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম কাগজের কল কর্ণফুলী কাগজকল এবং দেশের বৃহত্তম পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া রয়েছে রেয়ন কল, ঘাগড়া বস্ত্র কারখানা, উপজাতীয় বেইন শিল্প, বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প, হাতির দাঁতশিল্প ইত্যাদি।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ছাড়াও এখানে আবাসিক হোটেল ও মোটেল রয়েছে অর্ধশতাধিক। কাপ্তাই হ্রদের দ্বীপ ও পাড়ে আছে পর্যটন স্পট ও রিসোর্ট। রাঙামাটিতে প্রতিদিন হাজারখানেক পর্যটক ঘুরতে আসেন। ভরা মৌসুমে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে পর্যটন করপোরেশন রাঙামাটিতে কাজ করছে। এর আগে ১৯৬৪ সালে পর্যটনের জন্য বর্তমানের জায়গাটি চিহ্নিত করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গঠিত হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে বোট ক্লাব নাম নিয়ে সীমিত আকারে কার্যক্রম আরম্ভ হয়। বর্তমানে পর্যটন করপোরেশন হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, বার, ড্রিংকস কর্নার, নৌযান ভাড়া, গাড়ি পার্কিং, ট্যুর গাইড সার্ভিস, পর্যটনবিষয়ক ট্রেনিং প্রোগ্রাম, স্যুভেনির শপ, ঝুলন্ত সেতু তত্ত্বাবধান করে। নানা রকমের ইজারা ও ভাড়া দিয়ে এই কমপ্লেক্সের আয়ের খাত আছে ১৩টি।

স্বাধীনতার পর থেকে এই দীর্ঘ পথচলায় খুব একটা উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কিছু করতে পারেনি পর্যটন করপোরেশন।ইদানীং অন্যান্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা প্রকল্পের প্রতিযোগিতার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির সেবার মান কিছুটা বেড়েছে।

পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স ব্যবস্থাপক সৃজন বড়ুয়া বলেন, “আমরা পর্যটন খাতে সেবা বাড়াতে চাই। তার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে আমাদের কিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। কিছু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা যেমন শিশুপার্ক স্থাপন, যেখানে ছোট-বড় রাইড, ওয়াটার রাইড থাকবে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে প্রস্তাবনা প্রেরণ করেছি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে ঝুলন্ত সেতু ও মিলনায়তনকে যুগোপযোগী করা, সুইমিংপুল স্থাপন, ফোয়ারা স্থাপন, কেবল কার স্থাপন অন্যতম।”