রাজশাহীতে আলুর দামে বড় ধরনে পতন হয়েছে। এর ফলে পুঁজি হারাতে বসেছেন জেলার আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা। হিমাগারে আলু মজুত করে বিপাকে পড়েছেন তারা। বাজারে অন্য সবজির দাম বেশি হলেও তুলনামূলক আলুর দাম কম। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষি ও ব্যবসায়ীদের। গত বছরও হিমাগারে আলু রেখে লোকসান গুনেছিলেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
আলু চাষিদের দাবি, উৎপাদন ও হিমাগারে সংরক্ষণের খরচের হিসাবে প্রতি কেজি আলুতে লোকসান হচ্ছে ৩ থেকে ৪ টাকা। চাষিরা আলু বিক্রির জন্য হিমাগারে অপেক্ষা করলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। এদিকে হিমাগার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাজারে আলুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে আলুর দাম পাচ্ছেন না চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
আলু ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রথম দিকে আলুর দাম ছিল ২২ টাকা কেজি। এ বছরের প্রথম দিকে যারা আলু বিক্রি করেছেন, তাদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ী সামান্য লাভের মুখ দেখেছেন। বাকিরা এখন পর্যন্ত লোকসানের মধ্যে রয়েছেন।
রাজশাহীর পবা ও তানোর উপজেলার কয়েকজন বাণিজ্যিক আলু চাষির সাথে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে হিমাগারে সংরক্ষণের সময় আলুর যে দাম ছিল বর্তমানে বস্তা প্রতি দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কম। বর্ষাকাল শেষ হওয়ার এই সময়টাতে দূরের পাইকারি ব্যবসায়ীরা রাজশাহীতে আলু কিনতে ভিড় করেন। কিন্তু এবার তেমনটা ঘটছে না।
রাজশাহীর পবা উপজেলার ধর্মহাটা গ্রামের আলু চাষি শেখ জয়নুল জানান, জমি থেকে আলু সংগ্রহের সময় এমনিতেই দাম কম থাকে। এ কারণে চাষিরা হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেন। মার্চে আলু হিমাগারে তুলে সেপ্টেম্বর থেকে বের করা শুরু হয়। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে আলু আবাদের মৌসুম। ছয় মাসের জন্য হিমাগারে আলু রাখা হয় ভাড়ায়। চাষিরা আলু বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়া পরিশোধ করেন এবং লাভসহ পুঁজিও তুলে নেন। কিন্তু গত বছর থেকে আলুর দামে বিপর্যয় চলছে। গত বছর চাষি ও ব্যবসায়ীরা বস্তা প্রতি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছেন আলু বিক্রি না হওয়ায়। বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারগুলোতে পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে। এবারও লোকসানের আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় রয়েছে চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
পবা উপজেলার বায়া সরকার কোল্ড স্টোরেজের আলু ব্যবসায়ী শামিম হোসেন জানান, এ বছর তিনি ১০ হাজার বস্তা আলু কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন। প্রতি বস্তায় তার লোকসান হচ্ছে ৩০০ টাকা।
পবা উপজেলার আলু চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি এ বছর ৭০ বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করেছিলেন। আড়াই হাজার বস্তার মতো আলু কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন। এর মধ্যে কিছু বিক্রি করেছেন। আর কিছু আছে। এবার আলু বিক্রি করে তার অনেক লোকসান হচ্ছে। এবারও তিনি গত বছরের মতোই আলুর আবাদ করবেন। কেননা অন্য কিছু আবাদ করার মতো সুযোগটা কম। সামনের বছর দাম যে এমন থাকবে এমনও তো না।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার খাঁড়ইল গ্রামের বাণিজ্যিক আলু চাষি মতিউর রহমান বলেন, গত মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ছিল ১৭ টাকা। পরিবহণ ও হিমাগারে আলু সংরক্ষণে কেজিপ্রতি অতিরিক্ত খরচ হয় ৭ থেকে ৮ টাকা। সে হিসাবে কেজি প্রতি খরচ পড়েছে ২১ থেকে ২২ টাকা। বর্তমানে রাজশাহীতে পাইকারি বাজারে আলু প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১৮ টাকা থেকে ১৯ টাকা করে। ফলে কেজিতে লোকসান হচ্ছে ৩ থেকে ৪ টাকা।
রাজশাহী হিমাগার মালিক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে মোট ৩৬টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে প্রায় ৮২ লাখ বস্তায় ৪ লাখ ২৫ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল। প্রতি হিমাগারেই এখনও ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ আলু মজুত রয়েছে। সে হিসাবে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন আলু মজুত আছে। হিমাগার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চাষিদের এই বিপুল পরিমাণ আলু তুলে নিতে হবে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে। কোনো চাষি আলু উত্তোলনে সক্ষম না হলে তাকে হিমাগারের বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। কিন্তু বাজারে আলুর যে দাম তাতে এই সময়ে চাষিরা হিমাগার থেকে আলু বের করলে তাদের বস্তা প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে।
রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু বকর বলেন, খুচরা বাজারে ২৫ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে আলু। আর পাইকারিতে সাড়ে ১৮ টাকা থেকে ১৯ টাকা। এ সমস্যার কারণে সিন্ডিকেটের পকেটে যাচ্ছে চাষিদের টাকা।
রাজশাহীর আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা পরপর দুই বছর আলুতে লোকসানের কারণে চলতি মৌসুমে আলুর আবাদ নিয়ে শঙ্কিত কৃষি বিভাগ।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, “এবার বিক্রির ভরা মৌসুমেও আলুর দাম কিছুটা কম। চাষি ও ব্যবসায়ীরা লোকসান গোনায় আগামীতে আলু আবাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”