উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারটি কালের বিবর্তনে আগের অবস্থায় না থাকলেও আজও জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নানা প্রতিকূলতায় ব্যাপক আকারে না হলেও চারপাশে ছড়াচ্ছে জ্ঞানের আলো। গণমানুষের সংস্কৃতিচর্চা, মেধা-মনন ও জ্ঞানের বিকাশ এবং বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারটি। এটি বাংলাদেশের চারটি প্রাচীনতম গ্রন্থাগারের একটি উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগার। শিক্ষক, সংগঠক ও নাট্যকার শ্যামল ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক পুস্তুকের সংগ্রহ ছিল লাইব্রেরিটিতে। শুরুর কয়েক বছরের মাথায় লক্ষাধিক মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ভান্ডারে পরিণত হয় এ গ্রন্থাগার। এর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন পদ্মপুরাণ, গোবিন্দ কথামৃত এবং হিরণ্যকশিপুর শীর্ষক তিন খণ্ড হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি এখনো রয়েছে।
লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, পুরোনো উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি ১৮৫৪ সালে জেলার খ্যাতনামা ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও সহায়তায় মি. রয়েল উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর বগুড়ার নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান চৌধুরী লাইব্রেরির জন্য একটি নতুন ভবন নির্মাণ করেন। ১৯০৮ সালে জে এন গুপ্ত জেলা কালেক্টর তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্নের নামানুসারে এই লাইব্রেরির নামকরণ করেন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি। এরপর এর নাম নতুন করে বগুড়া জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার ১৯৮৪ সালে স্থাপিত হয়।
সরকারীকরণ
উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারটি পরবর্তী সময়ে ২৭ জুন ১৯৯৬ উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিকে সরকারীকরণ বিষয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভার পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়া পৌর উদ্যানের দক্ষিণ-পশ্চিমে লাইব্রেরির নতুন ভবন নির্মাণের জন্য শূন্য ৪০ একর জায়গায় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নতুন চারতলা ভবন নির্মাণ হয় এবং জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সঙ্গে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি একীভূত হয়ে নতুন নামকরণ করা হয় উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগার। এখানে অনুমোদিত জনবল ৯ জন। এখানে কর্মরত রয়েছেন ৩ জন।
কী রয়েছে
বগুড়া উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান ও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা আমির হোসেন জানান, এখানে নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে গণগ্রন্থাগারের বইয়ের সংখ্যা ৫৭ হাজার। এর মধ্যে ৮ হাজার বই খবই দুষ্প্রাপ্য। এখানে শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে দৈনিক পত্রিকা ১৪টি, সাপ্তাহিক ৪টি, পাক্ষিক ২টি, মাসিক ৬টি, ত্রৈমাসিক ৩টি ও ষাণ্মাষিক ১টি রাখা হয়। এ প্রন্থাগারের দৈনিক পাঠক উপস্থিতি ১৫০ থেকে ২০০ জন। এখনো পাঠকদের জ্ঞান আহরণের কেন্দ্রস্থল এ লাইব্রেরিটি। প্রতিবছর নতুন বই কেনা হয়। অর্থ বরাদ্দ দেয় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আর বই কিনে পাঠায় গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। এখানে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো তিনটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে। সেগুলো হলো পদ্মপুরাণ, গোবিন্দকথামৃত ও হিরণ্যকশিপুর। এগুলো কার মাধ্যমে এখানে এসেছে, তার সঠিক তথ্য নেই।
গত ২৪ আগস্ট বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান জানান, “আমরা মেসে থাকি। সেখান থেকে বন্ধুরা কয়েকজন একসঙ্গে এসে চাকরির জন্য পড়াশোনা করছেন। মেসে থাকলে মোবাইল আড্ডায় মনোযোগ চলে যায়। কিন্তু এখানে এই আড্ডা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ বেশি হয়।” তিনি বলেন, ‘উডবার্ন লাইব্রেরির পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানে এসে অনেক উপকৃত হই। কারণ, এখানে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মূলত একাডেমিক পড়ালেখা করি। পাশাপাশি এখানে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
আজিজুল হক কলেজের আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান জানান, প্রতিদিন আসেন। তিনিও চাকরিপ্রত্যাশী হিসেবে গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক। পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকা, সমমাময়িক বিষয় এখানে পাওয়া যায়। মেহেদি আরও জানান, মেসে তেমন পড়ালেখার পরিবেশ পাওয়া যায় না। এখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়া যায়। এ জন্য উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারে আসা।
আলিফ ফজলে শেখ জানান, তার বাড়ি জয়পুর হাট। সে এখানে মেসে থেকে লেখাপড়া করেন। তিনি তার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে এই উডবার্ন গ্রন্থাগারের খোঁজ পান। এর পর থেকে আসা-যাওয়া শুরু। এখানে বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্প পড়েন তিনি।
পাঠক মাহফুজা লিমা জানান, বাড়ির চেয়ে লাইব্রেরিতে পড়ার মনোযোগ বেশি হয়। এখানে অনেক রেফারেন্স বই পাওয়া যায়।
৯ বছরের কিশোরী মালিহা জান্নাতি জানায়, দুই বছর হলো এই লাইব্রেরিতে আসে। এখানে শিশু-কিশোর বই, গল্পের বই, বিভিন্ন লেখকের নাম জানাসহ অনেক ভালো ভালো বই তাকে উৎসাহ জোগায়।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই লাইব্রেরিতে বই পড়তে দূরদূরান্ত থেকে জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা আসতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোহিনীমোহন ভট্টাচার্য্য, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র দত্ত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. সৈয়দ মুজতবা আলী, বিখ্যাত গণিত শাস্ত্রবিদ লেখক ব্রজেন্দ্রলাল শিরোমণি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসু, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি কিরণ শংকর দাসের মতো মহান ব্যক্তিদের পায়ের চিহ্ন রয়েছে। ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক পণ্ডিত ঋষিকল্প কিশোরীলাল রায়ও পড়াশোনা করেছেন এই লাইব্রেরিতে।
লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট আনিসুল হক বলেন, ‘১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে এসে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। তখন ওই লাইব্রেরি ছিল পৌর পার্কের ভেতর। তাদের অনেক বই, আলমারি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে এটি সরকারীকরণ হওয়ার পর আমরা পুরোনো লাইব্রেরির বইগুলো নিয়ে আসি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সে সময় অন্তত সাড়ে ৮ হাজার বই নতুন গ্রন্থাগারে আনা হয়। কিন্তু তাদের তালিকায় প্রায় ২৫ হাজার বই ছিল। যেগুলোর মধ্যে অনেক বই নিখোঁজ ছিল। এ ছাড়া প্রচুর বই একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।’
কর্মকর্তারা জানান, চাকরিপ্রত্যাশীদের বাইরে বিনোদনের জন্য বই পড়ার মতো পাঠক আগের থেকে কিছুটা কমেছে। এর কারণ হিসেবে বেশির ভাগই কিশোর-তরুণদের মোবাইলে বা ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহকে দায়ী করছেন পাঠক ও গ্রন্থাগারের কর্মকর্তারা।
সংকট
বিপুল বইয়ের সমাহারে সমৃদ্ধিশালী এই লাইব্রেরিতে রয়েছে জনবলসংকট। এখানে পদ রয়েছে ৯টি। এর বিপরীতে লাইব্রেরিতে কর্মরত ৩ জন। সহকারী লাইব্রেরিয়ান, লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট ও নৈশপ্রহরী। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ লাইব্রেরিয়ান, কম্পিউটার অপারেটর, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট, বুকসর্টার, অফিস সহায়ক, চেকপোস্ট অ্যাসিসট্যান্ট পদ দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে।
লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট বলেন, ‘উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগার হওয়া থেকেই এখানে জনবলসংকট রয়েছে। ওই পদের কাজগুলো আমরাই করে থাকি।’
সহকারী লাইব্রেরিয়ান আমির হোসেন বলেন, ‘প্রাচীন লাইব্রেরি হলেও এখানে পাঠকসেবা দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। পাঠকের মনের মতো সেবা ঠিকমতো দেওয়া যায় না। কারণ, এখানে ৯টি পদের বিপরীতে তিনজন ব্যক্তি আছি। প্রায় সাড়ে ৩০০ সদস্য ও বিপুল বই থাকায় এই তিনজন নিয়ে পাঠকদের সেবা দেওয়া কষ্টকর। এখানে জনবল বাড়ালে আমরা পাঠকদের আরও বেশি সেবা দিতে পারব।’