সভ্যতার সেই আদিকাল থেকেই কোনো না কোনো রূপে লিপিবদ্ধ জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে আসছে মানুষ। সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত সভ্যতার এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় একের পর এক কীর্তিস্তম্ভ গড়ে তুলেছে মানুষ, সমৃদ্ধ হয়েছে নানা অর্জনে। মানুষের চিরন্তন কীর্তির তালিকায় এমনই একটি অসাধারণ অর্জন গ্রন্থাগার। জ্ঞান সৃষ্টি, সেই জ্ঞানের কাঠামোবদ্ধ সংরক্ষণ এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করেছে গ্রন্থাগার।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে সরকারি উদ্যোগে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার ও বনলতার শহর নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কানাইখালী মাঠের পাশে একটি ভাড়া বাসায় যাত্রা শুরু হয় নাটোর মহকুমার গ্রন্থাগারের (তথ্য কেন্দ্র)। বর্তমানে যা নাটোর শহর থেকে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার উত্তরে ভবানীগঞ্জ মোড়ে অবস্থিত। এর বর্তমান নাম ‘জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার’। ৩৩ শতাংশ জমির ওপর নিজস্ব একতলা ভবনে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে স্থানান্তরিত হয়। এই ভবনের কক্ষ সংখ্যা দুটি।
জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মেরিনা জান্নাত জানান, বর্তমানে এখানে ৩১ হাজার ৮২৮টি বই আছে। এই বইগুলো ১০টি শ্রেণিতে ভাগ করে ক্যাটালগ অনুযায়ী সাজানো আছে। যেন পাঠক খুব সহজেই তাদের কাঙ্ক্ষিত বইটি খুঁজে পান।
মেরিনা জান্নাত আরও বলেন, “আমাদের এখানে দুটি কক্ষেই পাঠকদের জন্য বই পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, শেখ রাসেল কর্নার, শিশু কর্নার ও দলীয় কাজ বা গ্রুপ স্টাডির জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করা রয়েছে।”
পাঠকদের জন্য বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা ও কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে কোডিং শেখার আলাদা ল্যাপটপ। এখানে প্রতিদিন ১২টি জাতীয় পত্রিকা ও একটি স্থানীয় পত্রিকা নেওয়া হয়। সরকারি ছুটি বাদে সপ্তাহে প্রতি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত খোলা।
মেরিনা জান্নাত জানান, জাতীয় সব দিবস পালনের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনসাধারণের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি এবং গ্রন্থাগারের প্রতি আকৃষ্ট করার নিমিত্ত গ্রন্থাগারে সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম, যেমন বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতা, হাতের সুন্দর লেখা প্রতিযোগিতা, পাঠ প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া গ্রন্থ প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বেসরকারি গণগ্রন্থাগারসমূহকে অতি সহজ শর্তে তালিকাভুক্তিকরণ/রেজিস্ট্রেশন প্রদানের মাধ্যমে গ্রন্থাগারকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রন্থাগার ভবনটির দুই কক্ষেই বিভিন্ন পাঠক তাদের কাঙ্ক্ষিত বই পড়তে ব্যস্ত। তবে এখানে নারী পাঠক নেই বললেই চলে। দুই কক্ষে প্রায় ৫০-৬০ পাঠক রয়েছেন। যার মধ্যে মাত্র দুইজন নারী পাঠক চোখে পড়েছে।
গ্রন্থাগারটি চলছে মাত্র তিনজন কর্মকর্তা কর্মচারী দিয়ে। একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন জুনিয়র লাইব্রেরিয়ান ও একজন লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছে। এখানে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৩০-১৫০ জন পাঠক এসে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে জুনিয়র লাইব্রেরিয়ান মো. নাজবীর হাসান জানান, সাধারণত যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা হয় এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার আগে সবচেয়ে বেশি পাঠক সমাবেশ ঘটে। তখন পাঠকদের জায়গা সংকুলান হয় না।
গ্রন্থাগারে আসা রফিকুল নামের এক তরুণ জানান, তিনি নিয়মিতই এখানে বই পড়তে আসেন। তিনি তার একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের বই পড়ে থাকেন।
অপর এক মধ্য বয়সী পাঠক আব্দুর গণি জানান, তিনি প্রতিদিন বিকেলে এখানে দৈনিক পত্রিকা পড়তে আসেন।
চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে আসা আঁখি খাতুন নামের এক তরুণী জানান, এখানকার পরিবেশ বেশ ভালো। তবে পড়ার জন্য কক্ষসংখ্যা বাড়ালে পরিবেশটা আরও ভালো হতো।