‘হেড স্যার ফাঁকে ফাঁকে আসেন, আবার চলে যান’

রিজাউল করিম, সাতক্ষীরা প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২, ০৯:৫৬ পিএম

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ১২২ নম্বর খোলপেটুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষক সংকটসহ প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের চরম উদাসীনতা বিদ্যালয়টির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

সরেজমিনে রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে গাবুরা খোলপেটুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় ছাত্রছাত্রীরা ছোটাছুটি করছে। তিনটি শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করছেন দুই জন প্যারা শিক্ষক ও একজন সহকারী শিক্ষক।

হাজিরা খাতা অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণিতে ৬০ জন ছাত্রছাত্রী থাকলেও ১৪ জন উপস্থিত, চতুর্থ শ্রেণিতে ৬৮ জনের স্থলে ১৯ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ৮০ জনের স্থলে ২৭ জন উপস্থিত রয়েছে।

অফিস কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, টেবিল চেয়ারে ধুলার আস্তরণ পড়েছে, মাকড়সা জাল বুনেছে। দেখলে মনে হবে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে অফিস কক্ষটি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক শ্যামনগরে থাকেন। মাসে এক-দুইদিন স্কুলে আসেন। বাকি সময় কাজ আছে বলে স্কুলে আসেন না। তিনি টানা ১৮ বছর বিদ্যালয়টিতে কর্মরত।

বিদ্যালয়টিতে খাতা কলমে চারজন শিক্ষক থাকলেও সহকারী শিক্ষক মিরা বালা প্রশিক্ষণে রয়েছেন। ফরহাদ হোসেন সাময়িক বরখাস্ত হয়ে আছেন। অপর সহকারী শিক্ষক বুদ্ধদেব জোয়ার্দার বিদ্যালয়ে আসেন অনিয়মিত।

মূলত স্থানীয় বাবু খান, শাহাদাত হোসেন ও কুমকুম আক্তার নামে তিন কলেজ শিক্ষার্থীকে প্যারা শিক্ষক বানিয়ে ৪৩৩ জন ছাত্রছাত্রীর পাঠদান চলছে বিদ্যালয়টিতে।

বিদ্যালয়ে গেলে সহকারী শিক্ষক বুদ্ধদেব জোয়ার্দার প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যথাসময়ে উপস্থিত থাকেন বলে দাবি করলেও হাজিরা খাতা দেখাতে বললে সাদাসিধা ভাষায় জানান, “হাজিরা খাতা আলমারিতে। আর চাবি হেড স্যারের কাছে, স্যার যখন আসে তখন স্বাক্ষর করি।”

এ সময় প্রধান শিক্ষক শেষ কবে বিদ্যালয়ে এসেছেন প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেনি।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি হাফেজ মাহমুদুল হাসান বলেন, “বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় জমিদান থেকে শুরু করে ম্যানেজিং কমিটিতে থেকে কাজ করেছি। কয়েকবছর ধরে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে হতাশ হচ্ছি। বিদ্যালয়ে বর্তমানে কোনো ম্যানেজিং কমিটি নেই, শিক্ষকও নেই।”

বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখার সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্পের ছলে আড্ডা দেওয়ার সময় দেখা যায়, সর্বোচ্চ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরাও দেখে বাংলা পড়তে পারে না, এমনকি নিজেদের নাম পর্যন্ত লিখতে পারে না।

এ সময় শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে, “হেড স্যার শ্যামনগরে থাকেন। ফাঁকে ফাঁকে আসেন, আবার চলে যান।”

অভিভাবক আবুল কালাম ও মরিয়ম বেগম জানান, স্কুলে বর্তমানে ম্যানেজিং কমিটি নেই। শিক্ষক সংকট রয়েছে। অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের কোনো সম্পর্ক নেই। হেড স্যার আসেন না। থাকেন শ্যামনগরে। তিনজন প্যারা শিক্ষক দিয়ে নিজের কাজ সারেন।

গাবুরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার খান হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, “এই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে দেলোয়ার হোসেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। তার খামখেয়ালীপনায় ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সুরাহা হয়নি। তিনি নিজে স্কুল করেন না। আর বিদ্যালয়ে শিক্ষক রাখার বদলে নিজের স্বার্থের জন্য শিক্ষকদের বদলিতে সুপারিশ করেন।”

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. রফিজ মিঞা জানান, প্রধান শিক্ষক নিজে স্কুল না করে বেতনের টাকায় তিনজন প্যারা শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালানোর বিষয়ে সত্যতা পেলে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্যারা শিক্ষকদের টাকা দিয়ে রাখা যাবে, তবে এলাকাবাসী বা ম্যানেজিং কমিটি বিষয়টি দেখবে।