জুন মাসে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর গত ১৬ জুলাই রাতে মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় তলিয়ে গিয়েছিল পুরো সিলেট নগর। নজিরবিহীন এই জলাবদ্ধতার জন্য ওই সময় অতিবৃষ্টি ও নগরবাসীর অসচেতনতাকে দায়ী করেছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। পরে গত ১৯ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তিনি জানিয়েছিলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮টি স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করা হয়েছে। এসব টিম নগরের যেখানে জলাবদ্ধতা সেখানে গিয়ে কাজ করবে।
সিসিক মেয়রের ওই বক্তব্যের পর মাত্র দেড় মাসের মাথায় আবারও ভারি বর্ষণে ডুবেছে সিলেট নগরী। সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে শুরু হওয়া ভারি বর্ষণে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তলিয়ে যায় সিলেট নগরের অধিকাংশ এলাকা। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি হয়েছে কিছু কিছু এলাকায়। তলিয়ে যায় বাসা-বাড়ির আঙিনা। বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।
নগরবাসী এমন দুর্ভোগ পোহালেও সিসিকের সেই স্ট্রাইকিং ফোর্সের দেখা মেলেনি। বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়েও জলাবদ্ধতা নিরসনে তাৎক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরা মাঠে নামার খবর পাওয়া যায়নি। এতে প্রশ্ন উঠেছে—আসলেই কী জলাবদ্ধতা নিরসনে স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করেছে সিসিক?
তবে সিসিকের জনসংযোগ দপ্তর বলছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করা হয়েছে। সোমবার বিভিন্ন এলাকা তারা পরিদর্শন করেছেন। তবে কোন এলাকা তাঁরা পরিদর্শন করেছেন তা বলতে পারেননি।
এদিকে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার জন্য সিসিকের ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই’ দায়ী করেছেন সচেতন নগরবাসী। তাদের দাবি, নগরের ছড়া-খালজুড়ে অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজ, ড্রেনের উন্নয়নকাজে ধীর গতি ও যত্রতত্র খোঁড়াখুড়ির কারণেই সিলেটবাসীর দুর্ভোগ কমছে না। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর শুকনো মৌসুমে ধুলোবালি—কোনো মৌসুমেই ভালো নেই সিলেটের মানুষ। কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হলেও জনগণের দুর্ভোগ লাগবে ভ্রূক্ষেপ নেই সিসিকের।
সোমবার সকাল ৬টা থেকে সিলেটে শুরু হয় ভারি বৃষ্টিপাত। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সিলেটের বিভিন্ন এলাকায়। তলিয়ে যায় অনেক এলাকার বাসাবড়ি-রাস্তাঘাট। বিভিন্ন এলাকায় কোথাও গোড়ালি, কোথাও হাঁটু সমান পানি হতে দেখা গেছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, তিন ঘণ্টার ভারি বর্ষণে নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সোমবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ১০৮ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পরে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া বর্ষণে নগরের চৌহাট্টা, দাড়িয়াপাড়া, মিয়া ফাজিলচিশত, সুবিদবাজার, পাঠানটুলা, কাজলশাহ, শামীমাবাদ, ঘাসিটুলা, শিবগঞ্জ, দরগা গেট, পায়রা, রাজারগলি, ভাতালিয়া, আখালিয়া, রায়নগর, উপশহর, জল্লারপাড়, তালতলাসহ অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এসব এলাকার প্রধান সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে যায়। বাসা-বাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। বিশেষ করে ভোগান্তিতে পড়েন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীরা। সকাল ৮টায় অফিসসূচি থাকায় অনেকেই সময়মতো কর্মস্থলে যেতে পারেননি। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। হাসপাতালের সামনে জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় রোগীদের অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বাভাবিক ছিল।
ভুক্তভোগী শামীমাবাদ এলাকার বাসিন্দা আব্দুল লতিফ বলেন, “কয়েক মাস থেকে অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় পুরো এলাকা। আজ সকালে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দিতে গিয়ে নজিরবিহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।”
নগরের মদিনামার্কেট এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী সাইদুল ইসলাম বলেন, “সকাল ৮টার মধ্যে অফিসে না গেলে বিলম্বে অনুপস্থিত বলে ধরা হয়। সুবিদবাজার এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে সময়মতো অফিসে যেতে পারিনি।”
পায়রা এলাকার বাসিন্দা রাজীব চৌধুরী বলেন, “মধ্যরাতে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে পায়রা এলাকায় রাত থেকেই পানি জমে। অনেক বাসা-বাড়ি ও দোকানে পানি ওঠে। সামান্য বৃষ্টি হলেই পায়রা এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অথচ এর কোনো সমাধান সিটি করপোরেশন করছে না। এ অবস্থায় স্থানীয় মানুষের ভোগান্তি দূর হচ্ছে না।”
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, “স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করা হয়েছে। তারা সোমবার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছেন।”
এ ব্যাপারে কথা বলতে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।