সন্ধ্যায় হলেই জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি। পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা। তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তাঘাট। এগিয়ে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়েছে ক্লিনিক। গত সাত বছরেই পাল্টে গেছে এখানকার দৃশ্যপট।
রোববার (৩১ জুলাই) লালমনিরহাটে দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ছিটমহল বিনিময়ের সপ্তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। সদর উপজেলার ভিতরকুটি বাঁশপচাই বিলুপ্ত ছিটের বাসিন্দারা রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বালন ও কেক কেটে আনন্দ উল্লাস করেন।
কেককাটা অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক আবু জাফর, জেলা পরিষদ প্রশাসক মতিয়ার রহমান, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন, ভিতরকুটি বাঁশপচাই ছিটমহলের সাবেক সভাপতি হারুনার রশিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সন্ধ্যা থেকে চলে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন।
এদিকে রোববার দুপুরে পাটগ্রাম উপজেলার বাঁশকাটা কমিউনিটি ক্লিনিকে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন, বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বাবুল। আরও উপস্থিত ছিলেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা নজরুল ইসলাম ও বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি গোলাম মতিন রুমি।
একাধিক বিলুপ্ত ছিটমহল ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। সরকারি উদ্যোগে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে পাকা রাস্তা, ডিজিটাল সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, পুলিশ ফাঁড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ-সংযোগ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েল, কমিউনিটি সেন্টার, সোলার প্যানেল দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী, প্রতিবন্ধীদের জন্য করে দেওয়া হয়েছে ভাতার কার্ড। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৬টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সদর উপজেলার বিলুপ্ত ভিতরকুটি ছিটমহলের ৬৫ বছর বয়সী বাসিন্দা এসহাক আলী বলেন, “জীবনের শেষ বয়সে ভোটার হয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে আমরা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছি। পেয়েছি নতুন পরিচয়।”
উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল বাঁশকাটার বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, “নিজেদের পরিচয়টাও দিতে পারতাম না আমরা। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা সমস্যায় ভোগান্তির শেষ ছিল না। কিন্তু ছিটমহল বিলুপ্তের ফলে ‘ভোগান্তির দিন’ ইতিহাস হয়ে গেছে। উন্নয়নের ছোঁয়া এখানকার বাসিন্দাদের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিটমহলের চিত্রও পাল্টে গেছে।
১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি মোতাবেক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিলুপ্তির ফলে বন্দিজীবনের অবসান ঘটে ভারত-বাংলাদেশের মোট ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। এর মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং ৫১টি ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের ১১১টির মধ্যে কুড়িগ্রামে ১২, লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬ এবং নীলফামারীতে চারটি ছিটমহল ছিল। লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে সদর উপজেলায় দুটি, হাতিবান্ধা উপজেলায় দুটি ও বাকি ৫৫টির অবস্থান পাটগ্রাম উপজেলায়।