কুসিক নির্বাচন

জয়-পরাজয়ের সমীকরণ বদলে দিতে পারে পাঁচ ফ্যাক্টর

মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, কুমিল্লা প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২২, ০৬:৫৫ পিএম

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে বুধবার (১৫ জুন)। এতে ঐতিহ্যবাহী এই নগরীতে সৃষ্টি হয়েছে এক উৎসবমূখর পরিবেশ। এতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচজন। তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস মিলেছে। শেষ পর্যন্ত নৌকা প্রতীকের আরফানুল হক রিফাত, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত নিজাম উদ্দিন কায়সারের মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।

প্রার্থীদের সবাই ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ছুটে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উন্নয়ন আর সুশাসনের। আলোচিত তিন প্রার্থীর পক্ষেই চলেছে তুমুল প্রচারণা। পোস্টারে পোস্টারে ছেঁয়ে গেছে নগরীর প্রতিটি রাস্তা, গলি আর ভবনের দেয়াল। প্রচার-প্রচারণা শেষে কুমিল্লা এখন রীতিমতো উৎসবের নগরী। কিন্তু এতকিছুর পরও কয়েকটি ফ্যাক্টর নিয়ে অস্বস্তিতেই রয়েছেন এগিয়ে থাকা তিন প্রার্থী। তিনজনেরই রয়েছে প্লাস-মাইনাস পয়েন্ট। এসব নিয়ে তাই চলছে নানা বিশ্লেষণ আর হিসাব-নিকাশ।

সরেজমিন কুমিল্লার নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপে ওঠে এসেছে তেমন পাঁচটি ফ্যাক্টর। সেগুলো হলো- জলাবদ্ধতা, যানজট, নারী ভোটার, সংখ্যালঘু ভোটার ও নতুন ভোটার। এগুলোই নির্ধারণ করবে কুসিক নির্বাচনের ফলাফল। পাঁচ সমীকরণের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কুসিক নির্বাচনে প্রধান তিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জয়-পরাজয়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সার্ভিস ড্রেন না থাকায় অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায় এ নগরী। সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। সরু রাস্তাঘাট, যত্রতত্র গড়ে ওঠা বহুতল ভবন, অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি নগর এখন কুমিল্লার পরিচয়। পানি নিষ্কাশনে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতিটি ওয়ার্ডেই যানজট, জলাবদ্ধতা নিত্য সঙ্গী এখানকার নাগরিকদের। বিগত দুই নির্বাচনেও এ ইস্যুটিই ছিল অন্যতম ফ্যাক্টর।

জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন প্রার্থীরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরের পাঁচ বছর পর এ রকম নগর জনপ্রত্যাশার সঙ্গে মেলে না। এবারও প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির শীর্ষে রয়েছে এ সমস্যার সমাধান। একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই নগরীর রাস্তাগুলো নালা-নর্দমার ময়লা পানিতে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে শহরের প্রাণকেন্দ্র সংলগ্ন ঝাউতলা, বাদুরতলা, জিলা স্কুল সড়ক, ভিক্টোরিয়া কলেজসহ শহরের অধিকাংশ এলাকা। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এ ইস্যুটিই নিয়ে এসেছেন সামনে।

কুসিকবাসীর আরেকটি বড় সমস্যার নাম যানজট। শহরে এখন বৈধ যানের চেয়ে অবৈধ যানের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে সাড়ে দশ হাজার লাইসেন্সের বিপরীতে রিকশা চলে অন্তত ৩০ হাজার। ইজিবাইক চলে আরও ২৫ হাজার। সিটি করপোরেশনে ট্রাফিক পয়েন্ট রয়েছে ছয়টি। অপ্রশস্ত রাস্তা ও ফুটপাথ এবং জলাবদ্ধতার কারণে যানজট লেগে থাকে কান্দিরপাড়, বাদুরতলা, রাজগঞ্জ, চকবাজার, টমছমব্রিজ এলাকায়।

এছাড়া কুমিল্লা শহরে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ গাড়ি চলাচল করে। শহরের মধ্যে তিনটি ইন্টার সেকশন রয়েছে। আলেখারচর ক্রসিং হলো কুমিল্লা শহরের প্রবেশ দ্বার। ওই ক্রসিং দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশের গাড়িগুলো প্রবেশ করে। প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, “আমি নিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে রাস্তা, ড্রেন ও ফুটপাথ উন্নয়ন, ড্রেনের আবর্জনা পরিষ্কারে তদারক করেছি। জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে একটি মাস্টার প্ল্যানও করা হয়েছে। মেয়র নির্বাচিত হলে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক সম্প্রসারণ ও খাল সংস্কারের মাধ্যমে নগরীর জলাবদ্ধতা ও যানজট  নিরসনে প্রাধান্য দেবো।”

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত বলেন, “মেয়র নির্বাচিত হলে কুমিল্লা নগরীর জলাবদ্ধতা, যানজটসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করব।”

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৩০ হাজার। পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা কিছুটা বেশি। বিশেষ করে শহরের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের নারী ভোটাররাই জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন। নারী ভোটারদের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। গত নির্বাচনগুলোতেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে নারী ভোটারের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।

অন্যদিকে সংখ্যার দিক থেকে যেমন পুরুষ ভোটার কম, কর্মজীবীর সংখ্যা বেশি। প্রায় ১৫ হাজারের বেশি পুরুষ ভোটার চাকরি সূত্রে অবস্থান করছেন বিদেশে কিংবা জেলার বাইরে। ইচ্ছে করলেও তাদের বড় অংশটি ভোটের দিন উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ফলে কুসিক নির্বাচনে নারী ভোটাররাই হয়ে দাঁড়িয়েছেন মূল ফ্যাক্টর। তাই নারী ভোটাররা যে প্রার্থীর পক্ষে ঝুঁকবে ফলাফল তারই অনুকূলে যাবে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটারদের এক চতুর্থাংশ হচ্ছে সংখ্যালঘু। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে দেড় শতাধিক এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এ ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার। এ হিসেবেও এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। ঐতিহ্যগতভাবে সংখ্যালঘু ভোটারদের বিবেচনা করা হয় আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। তাই নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট অন্যান্য প্রার্থীদের জন্য বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।

সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপর ছিল কুমিল্লার হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, আন্তর্জাতিক সংগঠন মাইনরিটি রাইটস কমিশন ও স্থানীয় সংগঠন মাইনরিটি রাইটস ফোরামসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠন।

তবে নগরীর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংখ্যালঘু সব ভোট আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাবে এ ধারণা ঠিক না।

কুসিক নির্বাচনের আরেকটি ফ্যাক্টর নতুন ভোটার। এবার নগরীতে নতুন ভোটার প্রায় ২২ হাজার। যারা এবারই প্রথমবারের মতো ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন কুসিক নির্বাচনে।

নতুন ভোটারদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে তাদের পছন্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে ব্যক্তি ইমেজ, যোগ্যতা। তাদের কাছে দলীয় প্রতীক খুব একটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সামান্য সংখ্যক ভোটারই ভোট দেবে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই জয়-পরাজয়ে সমীকরণ বদলে দিতে পারে নতুন ভোটাররা।