পদ্মা সেতুতে জৌলুশ হারাবে দৌলতদিয়া?

রাজবাড়ী প্রতিনিধি প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২২, ০৮:২৯ এএম

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে ২৫ জুন। স্বপ্নের এই সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই দক্ষিণবঙ্গের মানুষের। তবে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দৌলতদিয়া ঘাটের স্থানীয় ব্যবসায়ী ও হকারদের।

ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, সেতু খুলে দিলে দৌলতদিয়া ফেরি রুটে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ অনেক কমে যাবে। ফলে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকার খাবার হোটেল থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ দোকান ও হকারের বিক্রিও কম যাবে অনেক গুণ ।

দৌলতদিয়া ঘাট এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, এই পাড়ে দেড় শতাধিক টংদোকান রয়েছে। যাত্রী ও যানবাহনের চাপ কমে গেলে এ ব্যবসাও কমে যাবে। তখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে।

ঘাট এলাকায় দুই শতাধিক খাবার হোটেল রয়েছে। তা ছাড়া ভ্যানে করে বা মাথায় করে পেয়ারা, ডাব,আনারস, ডিম ও ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিন শতাধিক ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তি। সেতু চালু হলে এই ফেরি রুটে যাত্রী ও যানবাহন কমে তাদের বেচাবিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এসব হকার।

ধারণা করা হচ্ছে, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া (কুমারখালী, খোকসা), ফরিদপুর (সদর) থেকে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ার যানবাহনগুলো দৌলতদিয়া ঘাট হয়েই যাতায়াত করবে।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসি বলছে, কী পরিমাণ যানবাহন ও যাত্রীর চলাচল এই নৌপথ দিয়ে হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পদ্মা সেতু চালু হলে অল্প দিনের মধ্যেই তা বোঝা যাবে।

দৌলতদিয়া ঘাটের গ্রামীণ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক টিটু শেখ। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইদানীং তার ব্যবসায় লস যাওয়ায় শঙ্কায় রয়েছেন। সেতু চালু হলে এই অবস্থা খারাপ হবে বলেও মনে করেন।

টিটু শেখ বলেন, “মাসে আমার প্রায় ২ লাখ টাকা শুধু দোকান বাবদই খরচ হয়। তারপর সেখান থেকে আয় দিয়ে আমার সংসার চলে। এখনই যদি ব্যবসায় মন্দ হয়, সেতু চালু হলে দোকান বন্ধ করে চলে যেতে হবে।”

আরেক হোটেল ব্যবসায়ী লোকমান ফকির। দৌলতদিয়া লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বের হলেই তার খাবারের দোকান চোখে পড়ে। ভাই ভাই হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট।

লোকমান ফকিরের কণ্ঠেও একই রকম হতাশার সুর। তিনি বলেন, “যানবাহন যাত্রী কমে গেলে আমাদের একপ্রকার না খেয়ে থাকতে হবে। হোটেল ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বিল দিয়ে আমরা হোটেল চালাতে পারব না।”

কয়েকজন হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, “যদি যাত্রী আর গাড়ি না থাকে, মালিকের বেচাকেনা হবে না। আগের মতো রমরমা অবস্থা থাকবে না। তখন আমাদের চাকরিও থাকবে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় থাকব।”

টার্মিনাল এলাকায় ঘোল ব্যবসায়ী রতন ঘোষ। তিনি বলেন, “এই ব্যবসা আমার বাপ-দাদার আমলের। এমনও দিন গেছে, ৩ থেকে ৪ পাতিল ঘোল বিক্রি করেছি। এখন এক থেকে দেড় পাতিল বিক্রি হয়। সেতু চালু হলে না জানি কী হবে ব্যবসার।”

ছোট মুদিদোকান চালান নুরুল আনোয়ার মিলন। তিনি বলেন, “এটা তো কোনো জেলা শহর না। মানুষ এমনিতেই আসবে। ঘাটে যাত্রী গাড়ি পারাপার হতো তাই মানুষ আসত। সেতু চালু হলে মানুষ কম আসবে। তখন আমাদের দোকান বন্ধ করে রাখতে হবে।”

দীর্ঘদিন ধরে ১ নম্বর ফেরিঘাটের পাশে চায়ের দোকান করেন মোসলেন উদ্দিন। মোসলেন বলেন, “এইখানে চায়ের দোকান করে কোনোমতে ৫ ছেলেমেয়ে আর বউ নিয়ে সংসার চালাই। যদি ঘাটে যাত্রী কমে যায়, আমাদের ব্যবসা কমে যাবে। আমাদের দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হবে তখন।”

আরেক মুদিদোকানি সালাম বলেন, “ঘাটে যাত্রী, বাস, ট্রাক আসে বলেই আমাদের দোকান চলে। যদি এর অর্ধেক গাড়ি আসে, তখন যানজট থাকবে না। ফেরিতে গাড়ি সরাসরি উঠবে। তখন আমাদের আর ব্যবসাও হবে না।”

ভ্যান গাড়িতে করে লেবুর শরবত বিক্রি করেন আকবর। তিনি বলেন, “এখন যাত্রীর চাপ আছে। গরমের সময় ভালোই বিক্রি হয়। যদি যাত্রী কমে যায়, তখনকার অবস্থা নিয়ে শঙ্কায় আছি।”

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক লীগের দৌলতদিয়া শাখার সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন তপু বলেন, “সেতু চালু হলে এই ঘাট এলাকায় প্রায়  ১ হাজার হকার, ১০০ হোটেল, ২০০ ছোট ব্যবসায়ী, ২০০ বাড়িকেন্দ্রিক যে ব্যবসা আছে, তা শেষ হয়ে যাবে। প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। তারা পেশা পাল্টাতে বাধ্য হবে।”

তোফাজ্জেল হোসেন আরও বলেন, “সরকার ইতিপূর্বে দৌলতদিয়ায় যে নৌবন্দর স্থাপন করতে চেয়েছিল, সেটি স্থাপন করলেও এখানকার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভালো হতো। অন্তত এই অঞ্চলের অর্থনীতি নুইয়ে পড়ত না। আশা করি সরকার অচিরেই এখানে নৌবন্দর তৈরির কাজ শুরু করবে।”

রাজবাড়ী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ হাসান মৃধা বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের পরিবহন ব্যবসায় কোনোরকম নেতিবাচক প্রভাবই পড়বে না। তখন বরং আমরা স্বল্প সময়েই ফেরি পাব। দুর্ভোগ কমবে।”

সেতু চালু হলে কয়টি ফেরি চলবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে এখনো কিছু বলতে পারছেন না বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্টরা।

বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম এবং পাটুরিয়া ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ জানান, যানবাহন ও যাত্রীর ওপর নির্ভর করে ফেরি চলবে।