রংপুরের হাড়িভাঙ্গা যাচ্ছে সিঙ্গাপুরে

আব্দুর রশিদ জীবন, রংপুর প্রকাশিত: মে ২২, ২০২২, ০২:৫৯ পিএম

রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আমের সুনাম এখন দেশ-বিদেশে। তাই চাহিদা বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে দামও । আঁশহীন, ছোট আঁটি, ছাল পাতলা আর সুস্বাদু হওয়ায় দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও চাহিদা বেড়েছে হাড়িভাঙ্গার । এ বছর মালেশিয়া, নেপাল, ভুটান, ভারত ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হবে এই আম ।

নিজস্ব স্বকীয়তায় হাড়িভাঙ্গা ইতোমধ্যে পরিণত হয়েছে রংপুরের ‘ব্র্যান্ডে’। এই আম চাষে ভাগ্যও বদলেছে রংপুরের চাষিদের। গ্রামগুলোর চিত্রও বদলেছে। আমের মৌসুমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো রংপুরের অর্থনীতিতে তৈরি হয় আশা ভরসার জায়গা।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর হাঁড়িভাঙ্গা আমকে কেন্দ্র করে রংপুরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এ বছর তা আড়াই থেকে ৩০০ কোটি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। হাড়িভাঙ্গা নিয়ে স্বপ্ন বুনেন অনেকে। বাগানের মালিক, ফড়িয়া ব্যবসায়ী, পরিচর্যায় নিয়োজিত কৃষক, মৌসুমি আম বিক্রেতা, পরিবহনকারী-আমের লাভের অংশ পায় সবাই। করোনার দু-বছরে অনেক বেকার তরুণও হাঁড়িভাঙ্গা আমের ব্যবসায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।

শুরুতে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক হাড়িভাঙ্গা চাষ হলেও জনপ্রিয়তায় এখন বিভাগের রংপুর সদর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ অনেক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে এই আমের বাগান।

অন্য কোনো ফসলে দাম না পাওয়ায় এখন হাড়িভাঙ্গা আম চাষে ঝুঁকেছেন রংপুর অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ। জেলার উচু-নিচু, পরিত্যক্ত ও অনাবাদি জমিতে এই আম চাষ করে অনেকেই ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। কৃষক, দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন আমচাষী। তাই প্রতি বছরই বাড়ছে আম চাষের পরিধি।

ধান কিংবা অন্যকিছুর চেয়ে কয়েকগুন বেশি লাভ হওয়ায় আম চাষে ঝুঁকছেন তরুণরাও। এতে বেকার সমস্যার সমাধানের পথও খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ সরদারপাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম স্নাতকোত্তরে পড়ার পাশাপাশি গত ৪ বছর ধরে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ করছেন।

তিনি বলেন, “এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে লাভ আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। আর আম বিক্রি করলে লাভ ৩০-৩৫ হাজার টাকা। তাই ধান চাষ করা হচ্ছে শুধু খাবারের জন্য। আর আম চাষ করা হচ্ছে লাভের জন্য। গত বছর এক একর জমিতে লাগানো হাড়িভাঙ্গা আম গাছ থেকে ৪ লাখ টাকা আয় হয়েছে।”

গোপালপুর এলাকার আমচাষী আজম আলী জানান, এ বছর পাঁচ বিঘা জমির ২০০টি আমগাছে মুকুল আসার সময়ই দেড় লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। আরও পাঁচটি বাগান আছে তার। এসব বাগানে গত দুই বছর আগেও তিনি ধান চাষ করেছিলেন। আমে লাভ বেশি হওয়ায় ধান চাষ বাদ দিয়েছেন।

রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের মাইদুল ইসলামের দাবি, আমে পরিশ্রম ও ঝুঁকি কম হলেও লাভ বেশি। তাই বেশির ভাগ জমিতে আম বাগান করেছেন তিনি। এবার কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার হাড়িভাঙ্গা বিক্রির আশা তার । আম বিক্রির টাকা দিয়ে এক ছেলেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন মাইদুল।

১৯৯২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ শুরু করেন মিঠাপুকুরের আব্দুস সালাম। শুধু চাষবাদ নয়, এই অঞ্চলের হাঁড়িভাঙ্গা সম্প্রসারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার হাত ধরেই এ অঞ্চলের মানুষ এখন অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভের আশায় প্রতি বছর হাড়িভাঙ্গা আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

আব্দুস সালাম সরকার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রায় ৩০ বছর ধরে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ করছি। আমার দেখাদেখি অনেকে এই আম বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। রংপুরে হাড়িভাঙ্গার চাষ করে এখন অনেকেই স্বাবলম্বী।”

টেকসই অর্থনীতির জন্য হাড়িভাঙ্গা আমের সংরক্ষণে হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়ে আব্দুস সালাম বলেন, “সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই হাড়িভাঙ্গাকে ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হতে পারে।”

চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে এক হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ১২-১৫ টন আম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। হাড়িভাঙ্গা আম বিদেশে রপ্তানির জন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা ।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মাহাবুবার রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বিদেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বিশেষ যত্ন নিয়ে হাড়িভাঙ্গা চাষের জন্য কাজ করছে জেলার কৃষি বিভাগ । এবছর রংপুরের প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করা হয়েছে হাড়িভাঙ্গা আম। কোনো প্রকার কীটনাশক ছাড়া এই পদ্ধতি ব্যবহারে আম চাষীদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এবছর মালেশিয়া, নেপাল, ভুটান, ভারত, সিঙ্গাপুসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হবে এই আম।”

আমের মৌসুমে বহিরাগত ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, পরিবহন সুবিধা ও বাজারজাতকরণসহ সব ধরনের সহযোগিতার জন্য সার্বক্ষণিক তদারকি করে জেলা প্রশাসন।

রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, “দেশের নানা প্রান্তে হাঁড়িভাঙ্গা আম নির্বিঘ্নে সরবরাহ করতে বরাবরের মতো এবারও কাজ করবে জেলা প্রশাসন। বিশেষ করে পরিবহন ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য প্রশাসনের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে।”  

মৌসুমের শেষ দিকে পাকে এই আম । ফলে মানুষ মৌসুমি এই ফলের স্বাদ নিতে
পারে মৌসুম শেষেও।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আরও ব্যাপকভিত্তিতে বাণিজ্যিক চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে হাড়িভাঙ্গা আমই বদলে দিতে পারে এই জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থা।