বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের শেষ জেলা সাতক্ষীরা। এই উপকূলের চারদিকে রয়েছে পানি আর পানি। কিন্তু গ্রীষ্মের শুরুতেই উপকূলীয় এই এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
সাতক্ষীরার উপকূলজুড়ে রয়েছে ৮১২ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ হিসাবে ধরা হয় প্রায় ৬৭-৭০ কিলোমিটার এলাকা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ফিল্টারগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। এতে ব্যাহত হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ। এদিকে বেঁচে থাকার তাগিদে দূষিত পানি পান করছেন স্থানীয়রা। ফলে পেটের পীড়াসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন এলাকাবাসী।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবের পর সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলাজুড়ে। অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসের কারণে নষ্ট হয়ে যায় পানির উৎস। বিকল্পভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে ব্যবহার করতেন স্থানীয়রা। তবে অধিকাংশ পিএসএফ অকেজো হয়ে পড়ায় এখন আবারও বিপাকে পড়েছেন উপকূলবাসী।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন হেঁটে ৬-৮ কিলোমিটার দূর থেকে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। নারী ও শিশুরা দূরদুরান্ত হেঁটে পানি টেনে আনছে। এক কলস পানি আনতে বেলা কেটে যাচ্ছে। তা ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনেও দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে পানি সংগ্রহ করতে। এমন চিত্র উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরবাসীর এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
সরকারি কোনো সাহায্যও উপকূলবাসীরা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন। তারা জানান, মাঝে মাঝে বেসরকারি একটি সংস্থার সরবরাহ করা জারের পানির ওপরে ভরসা করে থাকতে হয় উপকূলবাসীর। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না তারা।
ভেটখালি গ্রামের জোহরা বেগম বলেন, “আমাদের পরিবারের জন্য ৭-৮ মাইলে হেঁটে পানি আনতে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াই। খুব কষ্ট হয়, পানি বয়ে আনতে। এক কলস পানির জন্য সারা দিন দাঁড়াতে হয়।”
সুন্দরবন গ্রামের আমেনা খাতুন বলেন, “মাটির পাত্রে বৃষ্টি পানি সংগ্রহ করে ২-৩ মাস ধরে খাই। এখন বৃষ্টি না হওয়ায় দূর থেকে পানি আনতে হয়।”
গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ছাত্তার গাজী বলেন, “চারদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। তবে খাওয়ার পানি নাই! ড্রামে করে নদীর ওপার থেকে নৌকা ভাড়া করে খাবার পানি আনতে হয়। মাঝে মাঝে মানুষের টাকা দিয়ে পানি আনায় নিতে হয়। শুধু পানি সংগ্রহেই প্রচুর শ্রমঘণ্টা ব্যয় হচ্ছে। নোংরা পানিতে গোসল করায় স্বাস্থ্য সংকটেও রয়েছি। সুপেয় পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।”
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তা রুজ্জামান জানান, সুপেয় খাবার পানির সংকট সমাধানের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও জেলা পরিষদ। সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পানির ট্যাংকি দেওয়া হয়েছে। যেসব এলাকার গভীর নলকূপ থেকে নোনা পানি উঠে সেসব এলাকায় পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা সুপেয় পানির সংকটে কাজ করে যাচ্ছি। গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করছি। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট স্থাপন করছি। আয়রন ও আর্সেনিক দূরীকরণেও আমরা কাজ করছি। আশা করি অচিরেই সুপেয় খাবার পানি সংকট দূর হবে।”
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো.নজরুল ইসলাম বলেন, “জেলার ৬৩ ভাগ মানুষ সূপেয় পানি পাচ্ছে, সরকারিভাবে এ তথ্য দেওয়া হলেও সুপেয় পানি পান করতে পারছেন না ৫০ ভাগের বেশি মানুষ। সংস্কারের অভাবে উপকূলীয় এলাকায় সরকারিভাবে বসানো ৬৫০টি পিএসএফের অধিকাংশই অকেজো হয়ে আছে। এদিকে জেলা পরিষদের ৭৩টি পুকুর পুনঃখনন করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণে। এছাড়া ১৫ হাজার গভীর নলকূপ, ৮ হাজার রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টারসহ ৪২ হাজার পানির উৎস চলমান রয়েছে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে প্রতিটি পারিবারে মাঝে পানির ট্যাংক বিতরণ করা হচ্ছে।”
তবে সব সুবিধাই অপর্যাপ্ত বলে দাবি উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দাদের। সুস্থ জীবনমান নিশ্চিতে, উপকূল অঞ্চলের মানুষদের বাঁচাতে সরকারিভাবে বড় ধরনের জলাধার বা পানির প্লান্ট তৈরি করার দাবি জানান উপকূলবাসা।