আমাদের অহংকার, ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ।
১৯৫২ সালে মাতৃভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ তিনি। পিতার নাম আবদুল লতিফ ও মাতার নাম রাফিজা খাতুন। মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার পারিল বলধারা গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। রফিকউদ্দিনরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও দুই বোন। ভাইদের মধ্যে রফিক ছিলেন সবার বড় এবং মা-বাবার প্রথম সন্তান। রফিকউদ্দিন ছিলেন মধ্যবৃত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা পেশা ছিল ব্যবসা। ব্যবসা করতেন কলকাতায়। সে সূত্রে রফিক কলকাতা গিয়ে অবস্থান করেন। দেশভাগের কারণে ১৯৪৭ সালে রফিকউদ্দিনের পিতার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। দেশে এসে তাঁর পিতা ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করেন। ঢাকার বাবুবাজারে আকমল খাঁ রোডে পারিল প্রিন্টিং প্রেস নামে ছাপাখানা চালু করেন।
রফিকউদ্দিন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার লেখালেখির হাত ছিল ভালো। এছাড়া সেলাই ও সূচিশিল্পেও বেশ দক্ষ ছিলেন। জানা গেছে, রফিক কলকাতায় সময়মিত্র ইনিস্টিটিউশন নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর মানিকগঞ্জের বায়রা স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বায়রা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে রফিকউদ্দিন মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। তিনি আইকম পর্যন্ত পড়লেও পরে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস ব্যবসা পরিচালনা করতে শুরু করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী ছাত্রজনতা ঢাকার রাজপথে আন্দোলনে নেমে আসে। সেই উত্তাল আন্দোলনে অংশ নেন রফিকউদ্দিন। তৎকালীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ভাষাপ্রেমী ছাত্রজনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষোভ মিছিলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল সামনে মিছিল আসলে পুলিশ অতর্কিত গুলি চালান। সেই গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে এবং তাঁর খুলি উড়ে যায়, ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পুলিশের গুলিতে ছিটকে পড়া মাথার মগজ হতে করে নিয়ে যান ডা. মশাররফুর রহমান খান নামে এক ব্যক্তি। রফিকউদ্দিনের লাশটি গোপন করার চেষ্টা করেন। গভীর রাতে সামরিক বাহিনীর প্রহরায় ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ রফিকের লাশ দাফন করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি, রফিকউদ্দিন, সালাম, জব্বার ও শফিউর শহীদ হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময় শহীদ রফিককের নামে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছে নানা স্থাপনা, সড়ক, সেতু, হল, ম্যুরাল, জাদুঘর ইত্যাদি।
ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ সরকার ভাষাসৈনিক ও ভাষাশহীদের একুশে পদক দিয়ে ভূষিত করে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ২০০০ সালে শহীদ রফিকউদ্দিনকে একুশে পদক দেওয়া হয়।
১৯৫২ সালে, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে রফিকউদ্দিন শহীদ হওয়ার পার তার নামেই মানিকগঞ্জ জেলা শহরের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয় শহীদ রফিক সড়ক।
মানিকগঞ্জের বুকজুড়ে রয়েছে ছোট-বড় অনেক নদী। আর মানিকগঞ্জের গর্ব ও অহংকার রফিকউদ্দিন। তার নামে ২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি মানিকগঞ্জের প্রবেশমুখ ঢাকা-সিঙ্গাইর সংযোগস্থল ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত হয় ‘ভাষাশহীদ রফিক সেতু’, যা এখন সিঙ্গাইর ও সাভার অঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান সেতু।
১৯৫২ সালে রফিকউদ্দিন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়ার দীর্ঘদিন পর, ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে পুরোনো বিজনেস স্টাডিজ ভবনের নাম পরিবর্তন করে ভাষাশহীদ রফিক ভবন নামকরণ করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নামে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাশহীদ রফিক-জব্বারের নামে হল তৈরি করা হয়।
গ্রামবাংলার নিভৃতে শ্যামল ছায়াঘেরা একটি গ্রাম রফিকনগর। ২০০৮ সালের ১৫ মে ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদের স্মৃতিকে চিরজাগ্রত রাখতে তাঁর জন্মস্থান সিঙ্গাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিকনগর নামকরণ করা হয়েছে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিনের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নে পারিল গ্রামে তৈরি করা হয়েছে ভাষাশহীদ রফিক স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘর।
মানিকগঞ্জ জনগণের দাবির ফলে মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পর, ২০১৭ সালে মানিকগঞ্জ শহরের খালপার এলাকায় শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে । এছাড়া শহীদ রফিকের স্মৃতি ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বহন করে মানিকগঞ্জ ‘শহীদ রফিক স্মৃতি পাঠাগার’, ‘শহীদ রফিক সমাজকল্যাণ পরিষদ’ ও ‘শহীদ রফিক মঞ্চ’ নামে সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনগুলো ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে।
ভাষাশহীদ রফিকের মতো তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন দেশপ্রেমী। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সব গণ-আন্দোলনে পরিবারের সদস্যরা যুক্ত ছিলেন। জানা গেছে, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে দেশের জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছে এই পরিবারের সদস্য ইসহাক। রফিকের ভাই আবদুস সালাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কষ্টের বিষয়, আবদুস সালাম পরবর্তী সময় তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন।
ভাষাশহীদ রফিকের আত্মত্যাগ কোনো দিন বৃথা যাবে না। বাংলাভাষী ও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়জুড়ে চিরদিন গর্ব এবং অহংকারের প্রতীক হয়ে আদর্শিক পথ দেখাবে।