চার হাজার দখলদার গিলে খাচ্ছে কীর্তনখোলা

মো. শহিদুল ইসলাম, বরিশাল প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২২, ০৮:৫৮ এএম

কীর্তনখোলা নদীতে একসময় কীর্তনের উৎসব হতো। আবার এই নদীতেই কৃষ্ণলীলার কাহিনি নিয়ে কীর্তনীয়রা গানে গানে মেতে থাকতেন। কিন্তু কীর্তনের সেই উৎসব হারিয়ে গিয়ে এখন পরিণত হয়েছে দখল আর দূষণ উৎসবে।

বর্তমানে যে যার মতো করে এই নদী ব্যবহার করছেন। কেউ নদীর পাড়-সীমানা দখল করে গড়ে তুলছেন বিভিন্ন স্থাপনা, কেউ আবার নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলছে ইট, বালু, পাথর ও কয়লা বিক্রির ডিপো ও লঞ্চ তৈরির ডকইয়ার্ড।

আইনানুযায়ী নদীর দুই তীরের যে অংশ শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, তাই হচ্ছে ফোরশোর। ওই ফোরশোর এলাকায় কারও অধিকার থাকে না। কেউ এই জমি দখল করলে তিনি দখলদার হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

এ বিধি ভঙ্গ করে কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা রসুলপুর চর, মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠী চর, পলাশপুর চর, খোন্নারের চর এবং চর বাড়িয়ার চর এবং দপদপিয়া ফেরিঘাটসংলগ্ন এলাকা দখল করেছে প্রভাবশালীরা। তবু কীর্তনখোলার তীর দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেননি প্রশাসন।

কীর্তনের সেই উৎসব হারিয়ে গিয়ে এখন পরিণত হয়েছে দখল আর দূষণ উৎসবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের রূপাতলী মৌজার অধীনে পূর্ব রূপাতলী এলাকার খলিফাবাড়ি পয়েন্ট থেকে উত্তরে কাটাদিয়া খাল পর্যন্ত কীর্তনখোলার পশ্চিম তীরে প্রায় দেড় কিলোমিটার ফোরশোর দখল করা হচ্ছে।

আরো দেখা গেছে, কীর্তনখোলার নদী তীরের খলিফাবাড়ি পয়েন্টে প্রকাশ্যে মেহগনিগাছ দিয়ে পাইলিং দিয়ে ব্লক ব্যবহার করে বালু ও মাটি ফেলে ভরাট করছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাইভিউল কবির স্বপন। সেখানে তিনি ইট, বালু, পাথর বিক্রির ডিপো ও লঞ্চ তৈরি-মেরামত ডকইয়ার্ড গড়ে তোলেন। ব্লক দিয়ে ডকইয়ার্ডের মধ্যে একাধিক দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে এখানে রাইভিউল কবির স্বপন কীর্তনখোলার তীরে ইটভাটা চালিয়েছেন। পরে প্রশাসনিক চাপে ওই ইটভাটা বন্ধ করেন।

জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নৌবন্দরের উত্তরে আমানতগঞ্জ খাল থেকে দক্ষিণের রূপাতলী সিএসডি গোডাউনের খালের দক্ষিণ পাড় পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর বিআইডব্লিউটিএর। বাকি অংশ জেলা প্রশাসনের। তবে বন্দর-সংলগ্ন নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরে উচ্চ জলরেখা থেকে তীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ফোরশোর রয়েছে, যার অর্ধেকই বেদখলে চলে গেছে।

আরও জানা গেছে, ইতিমধ্যে কীর্তনখোলার তীর দখলকারী ৪ হাজার ৩২০ জন অবৈধ দখলদারের খসড়া একটি তালিকা তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

পূর্ব রূপাতলী এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা জানান, সিটি ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধান গবেষণা রোডের পাকার মোড় এলাকায় কীর্তনখোলা তীরের খলিফাবাড়ি পয়েন্ট থেকে গাইড ওয়াল করে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশে এ বালু ভরাট করা হয়েছে। এরপরও কয়েক হাত দূরে বাঁশ ও লাঠির বেড়া দিয়ে ওই অংশও দখলের চেষ্টা চলছে।

স্থানীয়রা আরও জানান, রাইভিউল কবির স্বপন নানা কৌশলে কাগজপত্র তৈরি করে কীর্তনখোলা তীরের বিশাল অংশের মালিক হয়েছেন। এখন নদীর অংশ দখল করে জমির পরিমাণ বাড়াচ্ছেন। দুই বছর আগে নদী তীরের ওই অবৈধ দখল গুঁড়িয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।

এ বিষয়ে রাইভিউল কবির স্বপন বলেন, “খলিফাবাড়ি থেকে কাটাদিয়া খাল পর্যন্ত কীর্তনখোলা তীরে তার প্রায় ১৭ একর রেকর্ডীয় সম্পত্তি আছে। যেখানে পাইলিং দেওয়া হচ্ছে সেখানের একটি দাগে ৫৯ শতাংশ জমি ছিল। এখন আছে ২৫ শতাংশ। বাকিটা নদীতে ভেঙে গেছে। ভাঙন ঠেকাতেই পাইলিং দিয়ে মাটি ফেলা হচ্ছে।“

এ জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে স্বপন বলেন, “আমার সম্পত্তি রক্ষার জন্য আমিই প্রোটেকশন দিচ্ছি, কারও অনুমতি নিইনি।” গাইড ওয়াল নির্মাণে এবং ডকইয়ার্ডের কাজে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

স্বপন আরও জানান, বরিশাল জেলা প্রশাসনের কাছে কয়েক বছর আগে তার জমি মেপে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু প্রশাসন জমি মেপে বুঝিয়ে দেয়নি। তাই নিজের জমি নিজেই রক্ষার জন্য দেয়াল তুলছেন।

বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, “কীর্তনখোলা নদীর পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে দখলদারিত্বের কারণে। আগে কীর্তনখোলা নদীর প্রশস্ততা ছিল এক কিলোমিটার। তা দিনে দিনে দখলে হয়ে সংকুচিত হয়েছে।”

শিবলু আরা বলেন, “কীর্তনখোলা দখল প্রতিরোধ করা না হলে নগরী বিপন্ন হবে। নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ জীবন্ত সত্তা রক্ষায় প্রশাসনিক উদ্যোগ দ্রুত প্রয়োজন। আমরা চাই কীর্তনখোলার সব দখলদারের উচ্ছেদ করে কীর্তনখোলা নদীকে পুরোনো ঐতিহ্যের ফিরে আসুক। এর জন্য আমরা প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।”

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও নদীবন্দর কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ খাল থেকে রূপাতলী দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর বিআইডব্লিউটিএর। নদী তীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ফোরশোর রয়েছে, যার অর্ধেকই দিনে দিনে বেদখল হয়ে গেছে।“

বিআইডব্লিউটিএর এই কর্মকর্তা আরো জানান, ইতোমধ্যে দখলদারদের একটি খসড়া তালিকা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে নগরী এবং আশপাশে কীর্তনখোলা নদী দখলদারের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। নদীর জায়গা উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে জরিপ চলছে। দখলদারদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন এবং জমি জরিপ কার্যক্রম শেষ হলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।