সংসদ সদস্যের ছেলে, ভাই ও ভাতিজি মেয়র প্রার্থী

আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২১, ০৬:০২ পিএম

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর পারিবারিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আসন্ন পাবনার বেড়া পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে প্রকাশ্য রূপ পেয়েছে। 

মেয়র পদে ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা অ্যাড. এসএম আসিফ শামস রঞ্জন এবং তার ভাই সাবেক মেয়র আব্দুল বাতেন প্রার্থী হওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে নানা অনুযোগ-অভিযোগ ও অভিমান।

এদিকে এই দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর সঙ্গে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারই আপন বড় ভাইয়ের মেয়ে (ভাতিজি) এসএম সাদিয়া আলম। 

বেড়া পৌরসভার নির্বাচন ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছিল নানা গুঞ্জন। দেখা দিয়েছিল স্থানীয় রাজনীতি, জনপ্রতিনিধি, জনপ্রশাসন ও জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাবেক এই মন্ত্রীর ছেলে মেয়র পদে দলীয় প্রতীক নৌকা পাওয়ার পর থেকে চাচা ভাতিজার মধ্যে দ্বন্দ্বটা প্রকাশ্য রূপ পায়। প্রতীক বরাদ্দের পরপরই শুরু হয় উভয়গ্রুপের মধ্যে নির্বাচনী সহিংসতা। অভিযোগ একে অপরের দিকে। 

মেয়র পদের এই হেভিওয়েট দুই প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচন ঘিরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, হামলা, মারপিট, নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভোটারদের প্রভাবিত করা, হুমকিধামকি, এলাকা ছাড়া করার ভীতিসহ নানা অভিযোগের পাহাড় হয়েছে আসন্ন এই বেড়া পৌরসভার নির্বাচনে। 

বেড়া পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী আব্দুল বাতেন নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগ দিয়েছেন রিটার্নিং অফিসারের (জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা) কাছে। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন থেকে পাবনা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুকে আচরণবিধি মেনে এবং নিজ এলাকা ত্যাগের অনুরোধপত্র পাঠানো হয়। 

নির্বাচন কমিশনের অনুরোধপত্র তোয়াক্কা না করে স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজ ছেলেকে বিজয়ী করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন এমন অভিযোগ তুলে মেয়র প্রার্থী আব্দুল বাতেন (এমপির আপন ভাই) হাইকোর্টে রিট করেন।

সোমবার (২২ নভেম্বর) রিটের শুনানিতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ পাবনার বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এমপি নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা বাধাগ্রস্ত করছেন কিনা, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা জানাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা (জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা) মাহবুবুর রহমানকে নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়র প্রার্থী আব্দুল বাতেনের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।  

আব্দুল বাতেনের আইনজীবীরা জানান, সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর বড় ছেলে অ্যাডভোকেট এসএম আসিফ শামস রঞ্জন নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে লড়ছেন। নিজের ছেলেকে বিজয়ী করতে সংসদ সদস্য টুকু আচরণবিধি ভেঙে এলাকায় অবস্থান করে নির্বাচনী সভায় অংশ নিচ্ছেন।

আইনজীবীরা আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুসারে সংসদ সদস্যের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থানের সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন থেকে গত ১৪ নভেম্বর তাকে এলাকা ছাড়ার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও তিনি এলাকা ছাড়েননি। ছেলের নির্বাচনী সভায় অংশ নিয়ে তার উপস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল বাতেনের সমর্থক ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এমন কি তিনি নিজে আব্দুল বাতেনের সমর্থকদের দয়ামায়া না করে পিষে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। যার ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের হাতে এসে পৌঁছেছে। 

বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে হাইকোর্ট বেঞ্চ বেড়া পৌর নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মাহবুবুর রহমানকে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সদস্যকে দেওয়া এলাকা ত্যাগের চিঠির অগ্রগতি জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামি ২৫ নভেম্বর এ বিষয়ে শুনানির দিনধার্য্য হয়েছে। 

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকু ও তার ছেলে মেয়রপ্রার্থী আসিফ শামস রঞ্জনের সমর্থকদের ধারাবাহিক হুমকি ও হামলায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুল বাতেন জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তার নিরাপত্তার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। 

স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও জনসাধারণের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, একই পরিবার থেকে যদি তিনজন মেয়র প্রার্থী হয়। তাহলে আমরা বড়ই অসহায়। কাকে ভোট দিব আর কাকে ভোট দিব না। সবাইতো আওয়ামী লীগ সমর্থক। তারা বলেন, সদ্য সাবেক মেয়র আব্দুল বাতেনের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। নিজের ক্ষমতার দাপটে মিনি নৌবন্দর তৈরি করে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব তসরুপ, দুর্নীতির মামলা, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার হওয়াসহ নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এই মেয়র। সম্প্রতি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আনাম সিদ্দিকীকে লাঞ্ছিত করে পৌর মেয়রের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় পৌর নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী আব্দুল বাতেন, এসএম সাদিয়া আলম, এইচএম ফজলুর রহমান মাসুদ ও কেএস আব্দুল্লাহর সাথে। তাদের সম্মিলিত অভিযোগ, একের পর এক নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন সংসদ সদস্য। তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন তাকে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ তিনি মিথ্যা অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে এলাকা না ছেড়ে উল্টো বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকাশ্য ভোটারদের হুমকি দিচ্ছেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হওয়ায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে প্রভাবিত করছেন বলে তাদের অভিযোগ।

নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী অ্যাড. এসএম আসিফ শামস রঞ্জন বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নৌকা প্রতীক আমাকে দিয়েছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী পরাজয় নিশ্চিত জেনে একের পর এক মিথ্যা ও মনগড়া তথ্য ছড়াচ্ছেন। সর্বশ্রেণির ভোটে আমি নির্বাচিত হবো এমন দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থী টানা কয়েক মেয়াদে মেয়র থেকে পৌরসভাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। তার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। এসব নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে ভোটে পরাজয় আগাম জেনেই ভোটের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অশান্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। দলীয় কার্যালয় ভেঙেছেন। এখন প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের উপর নানা দোষ চাপিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।”

সাধারণ মানুষ সঠিক জবাব তাকে দেবেন বলে দাবি করেন রঞ্জন।

এদিকে গত ২০ নভেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ের জেলা আওয়ামী লীগের মাসিক সভায় বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় মেয়র প্রার্থী আব্দুল বাতেন ও জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য এইচএম ফজলুর রহমান মাসুদকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে তাদের দুজনের দলীয় সদস্য বাতিলের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে বলে এ তথ্য নিশ্চিত করেন জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অ্যাড. আব্দুল আহাদ বাবু।

নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সংসদ সদস্য অ্যাড. শামসুল হক টুকু বলেন, “এই এলাকার মানুষের ভোটে আমি এমপি নির্বাচিত। এই এলাকার ভোটার। আমি নির্বাচন আচরণ বিধি ভেঙ্গে কোনো কাজ করছি না। নির্বাচন কমিশন থেকে আমাকে বলা হয়েছে ‘আমি নির্বাচন আচরণবিধি মেনে চলি, আর সম্ভব হলে যেন এলাকার বাইরে থাকি’। নির্বাচন আচরণ বিধি ভঙ্গ করে কোনো কাজ আমি করছি না বলে দাবী করেন সংসদ সদস্য টুকু।”

বেড়া পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ও জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, “আদালতের নির্দেশনার পত্র আমার দপ্তরে আসার পরপরই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আদালতে উত্তর জানানো হবে। জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য অবহিত করা হয়েছে।” 

জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা (পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বলেন, “প্রার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। পুলিশ সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়েই কাজ করছে। আসন্ন বেড়া পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সম্পন্নের লক্ষ্যে জেলা পুলিশ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।”