কুমিল্লার বুক চিরে বহমান তীব্র স্রোতধারার নদী গোমতী। জেলার ৭টি উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় এ নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষিতে অবদান রাখলেও বর্ষায় কখনো কখনো এ নদী রুদ্র রূপধারণ করে বাঁধ ভেঙে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন।
জানা গেছে, ৭২ বছরে এ নদীর বাঁধ ২৯ বার ভেঙেছে। তবে প্রতিবারই বাঁধ ভেঙেছে গভীর রাতে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও ঠেকানো যাচ্ছে না ভাঙন। এভাবে বাঁধ ভাঙার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহের হাজার হাজার কোটি টাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
নদীর তীরবর্তী মানুষের একটাই প্রশ্ন, কবে নির্মিত হবে টেকসই বাঁধ?
এ বিষয়ে নদী নিয়ে গবেষণা করা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, বাঁধ নির্মাণে ডিজাইনে ত্রুটি, তদারকি না থাকা ও দুর্নীতিসহ নানা কারণে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয় না। তাই বর্ষায় বাঁধ ভেঙে যায়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল অর্থবরাদ্দ ও তদারকিতে জনবলসংকটকে দায়ী করেছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গোমতী নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলের ডুম্বর এলাকায়। নদীটি আঁকাবাঁকা পথে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কটক বাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবীদ্বার, মুরাদনগর, তিতাসের বুকচিরে প্রবাহিত হয়ে দাউদকান্দি উপজেলার শাপটা নামক স্থানে এসে মেঘনা নদীতে পড়েছে। বাংলাদেশ অংশে এ নদীর মোট দৈর্ঘ্য ১৩৫ কিলোমিটার।
বর্ষায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীসংশ্লিষ্ট এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয় এবং নদীর দুই তীরের বাঁধ হুমকির মুখে পড়ে। তখন এ নদীর পানির প্রবাহ মাত্রা ১০০ থেকে ২০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত ওঠানামা করে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ১৯৫২ সাল থেকে চলতি বছরের গত ২৩ আগস্ট পর্যন্ত গত ৭২ বছরে জেলার বিভিন্ন স্থান দিয়ে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙেছে ২৯ বার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর অন্য এক সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে সময়মতো ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত করা যায় না। গত ছয়টি অর্থবছরে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণে চাহিদা অনুপাতে সিকিভাগও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ কোটি টাকা চেয়ে পাওয়া গেছে ৪৮ লাখ ৮০ হাজার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৬০ লাখ বরাদ্দ চেয়ে পাওয়া গেছে ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “আমরা গবেষণায় দেখেছি, বাঁধ নির্মাণে ডিজাইনে ত্রুটি, মাটিদস্যু সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রতিরক্ষা বাঁধের কাছ থেকে মাটি কেটে নেওয়া, মাঠপর্যায়ে তদারকি না থাকা এবং দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করায় বর্ষায় বাঁধ ভেঙে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতিসহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। টেকসই বাঁধের জন্য পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণসহ তদারকি করা হলে ভাঙন ঠেকানো সম্ভব।”
কুমিল্লার পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ অলিউজ্জামান জানান, পানির অধিক চাপ ও নাব্যতাসংকটসহ নানা কারণে এ নদীর পানি বর্ষায় ফুল ফ্লাড লেভেলে অবস্থান করে। তখন বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে, কখনো ভেঙে যায়। এ ছাড়া বাঁধ মেরামতে চাহিদা অনুসারে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। প্রতি বছর সরকারের বরাদ্দের অর্থ দরপত্র আহ্বান করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ব্যয় করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বাঁধ দখল করে অবৈধভাবে নির্মিত হাজার হাজার ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ ও তদারকির জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনায় সময়মতো পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েও পাওয়া যায় না।